আজকের রবিবাসরীয় গল্প: আমিও পুরুষ

এএনএম নিউজের নতুন সংযোজন রবিবাসরীয় গল্প। ভালো লাগলে ফলো ও সাবস্ক্রাইব করবেন। প্রত্যেক রবিবার একটি করে নতুন গল্প নিয়ে হাজির হবে এএনএম নিউজ। যাতে থাকবে রহস্য, রোমাঞ্চ, প্রেম, ভয়, ভালোবাসা বা সমাজের প্রতিচ্ছবি। যা আপনাদের মন ছুঁয়ে যাবে শীঘ্রই।

author-image
Aniket
New Update
cover

File Picture

আমিও পুরুষ
অনিকেত দেবনাথ


   পড়ন্ত বিকেলের সূর্যের লাল আভাকে বিবর্ণ করে কালো মেঘের চাদরে ঢেকেছে আকাশ। এই কিছুক্ষণ আগেও নীল আকাশের গালে ভালোবাসার লাল আভা ফেলেছিল সূর্যের নরম আলো। কিন্তু এক লহমায় কেউ যেন কেড়ে নিয়েছে আকাশের সমস্ত খুশির মুহূর্ত। কিছক্ষণের মধ্যেই মেঘের চাদরের বাঁধ ভেঙে ঝোড়ে পড়বে অবাধ্য বৃষ্টির অগুনতি ফোটা গুলি। আকাশের শত বাধা মানতে নারাজ তারা।
 

 এই বৃষ্টির ফোটা গুলির মতই অবাধ্য হয়ে উঠেছে নীলাদ্রির চোখের জল। নীলাদ্রির শত বাধা অমান্য করে ঝোড়ে পড়তে চাইছে তারা। ইতিমধ্যেই নীলাদ্রির গাল বেয়ে নেমে এসেছে কয়েক ফোটা বেলাগাম জলের বিন্দু। তবে ঘন্টা খানেক আগেও নীলাদ্রির চোখে ছিল স্বউজ্জ্বল দীপ্তি। নীলাদ্রির গাল অদৃশ্য রঙ তুলির লাল রঙের স্পর্শে রঙিন হয়ে উঠেছিল। নিজের ভালবাসার মানুষটাকে সে প্রথমবার নিজের মনের কথা বলতে যাচ্ছিল। 
 

 নীলাদ্রি ও রৌত্রিকের বন্ধুত্বের শুরু ঠিক কিভাবে তা ওরা নিজেরাও জানেনা। ছোটোবেলা থেকে একসঙ্গে বড় হয়েছে ওরা। একে অপরের প্রত্যেক ছোটো বড়ো মুহূর্তের সাক্ষী ওরা। ওদের মাঝে অবশ্য আরেকজন রয়েছে, তিয়াসা। তিয়াসার সঙ্গে ওদের পরিচয় স্কুলে। ওরা যখন অষ্টম শ্রেণীতে পড়ছে তখন বাবার বদলির কারণে ওদের স্কুলে এসে ভর্তি হয় তিয়াসা। অল্প সময়ের ব্যবধানেই তিয়াসার সঙ্গে ওদের বন্ধুত্ব অটুট হয়ে ওঠে।

  বর্তমানে ওরা ৩ জনেই সদ্য স্কুলের গণ্ডি টপকে কলেজে উঠেছে। স্কুলে ৩ জনের একই বিভাগ থাকলেও কলেজে ওদের বিষয় আলাদা হয়েছে। রৌত্রিক ও তিয়াসার স্নাতক ডিগ্রির বিষয় রসায়ন। নীলাদ্রির বিষয় অঙ্ক। ফলে প্রকৃতির নিয়মেই ৩ অভিন্ন আত্মার মাঝে কোথাও যেন একটু দূরত্ব তৈরি হয়েছে ওদের অজান্তেই।

  তবে এই দূরত্বকে পাত্তা দিতে নারাজ ওরা ৩ জনেই। কলেজ শেষে কলেজের ঠিক সামনে দিয়ে বয়ে চলা গঙ্গার ঘাটে জমে ওঠে ওদের আড্ডা। চলে সন্ধ্যা ঘনিয়ে যাওয়ার পর পর্যন্ত। ধোঁয়া ওঠা চায়ের কাপের সঙ্গে রৌত্রিকের গিটারের টুংটাং ও মন ভোলানো গানে সময় ভেসে যায় গঙ্গার স্রোতের ন্যায়। তবে এরই মাঝে নীলাদ্রির মনে ভালোবাসার তার কতবার যে বেজে ওঠে ওরই সবচেয়ে কাছের মানুষটির প্রতি তা নিজেও গুনে শেষ করতে পারেনা নীলাদ্রি। 

  এই ভালোবাসার সূচনা বহু পূর্বেই, সেই স্কুল জীবন থেকে। তারপর থেকেই যত দিন বয়ে গিয়েছে ততই নীলাদ্রির মনে ভালবাসার গভীরতা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে অপরদিকের মানুষটাকে বলে ওঠার মাঝে বন্ধুত্ব সবথেকে বড় বাঁধা হয়ে উঠেছে ওর কাছে। ওদের এত বছরের বন্ধুত্ব এক লহমায় ধূলিসাৎ হয়ে গেলে তা কখনই মেনে নিতে পারবেনা নীলাদ্রি।

  এরই মধ্যে প্রকৃতির নিয়মে তৈরি হওয়া সেই সামান্য দূরত্ব ক্রমেই মাইল খানেক হয়ে উঠতে শুরু করে নীলাদ্রির কাছে। রৌত্রিক এবং তিয়াসার সঙ্গে দূরত্ব বৃদ্ধি পেতে শুরু করে নীলাদ্রির। তবে নীলাদ্রির সঙ্গে যত দূরত্ব বৃদ্ধি পেতে থাকে রৌত্রিক ও তিয়াসার, ততই কাছে আসতে শুরু করে ওরা একে অপরের। আগে গঙ্গার ঘাটের আড্ডায় নীলাদ্রি ছিল গল্পের কেন্দ্র বিন্দু। ওদের ২ জনকে ছাড়া কিভাবে ও কলেজে একঘেয়ে অঙ্কের ফর্মুলার মাঝে এতটা সময় কাটালো তা নিয়েই জমে উঠত ওদের আড্ডা। তবে সময়ের ব্যবধানে সেই আড্ডায় নীলাদ্রি শুধুই শ্রোতার ভূমিকা পালন করে। আড্ডার নয়া মোড়ে শুধুই রৌত্রিক ও তিয়াসার খুনসুটি।

  ক্রমেই সবকিছু বিরক্তিকর হতে থাকে নীলাদ্রির কাছে। রৌত্রিক কি বুঝতে পারেনা ওর ভালোবাসার কথা? তারপরেও কিভাবে তিয়াসার সঙ্গে সম্পর্কে জড়াতে পারে রৌত্রিক? এই প্রশ্নই বারবার ভেসে উঠতে থাকে নীলাদ্রির অবুঝ মনের অন্দরে। 

  নিজের ‘ভালবাসার’ সত্য ওদের দুজনকেই বলে দিতে চায় ওর মন। “ওরা কি ওকে বুঝবেনা?” – সবকিছু জানলে ওরা নিশ্চই ওর কথা বুঝবে। তবে নিজের মনের কথা মনেই দমিয়ে রাখতে হয় নীলাদ্রিকে। হাজারো দুশ্চিন্তার ভিড়ে নীলাদ্রির মনের গোপন সত্য যেন মনের মাঝেই লুকিয়ে পড়তে চায়। 

  এরই মধ্যে শিতের ছুটিতে দার্জিলিং যাওয়ার পরিকল্পনা করে ফেলে রৌত্রিক ও তিয়াসা। সন্ধ্যা কালীন এক আড্ডায় সেই কথা নীলাদ্রিকে জানায় ওরা। নীলাদ্রি ছাড়া ওরা যে দার্জিলিং যাওয়ার অনুমতিই পাবে না। তাই নীলাদ্রিকে যেতেই হবে। ওদের যুক্তি নীলাদ্রির মনের ফাটল আরও বৃদ্ধি করে। ওদের মাঝে নিজের গুরুত্ব কোথায় তা খোঁজার চেষ্টাও ওর কাছে নিষ্ফল বলে মনে হয়। তবে নিজের ভালোবাসার তাগিদেই দার্জিলিং ভ্রমণে মত দেয় নীলাদ্রি। 

  দিন কয়েক বাদেই সবুজ পাহাড়ে ঢাকা স্বপ্নভূমিতে পৌঁছে যায় ওরা। এতদিনের সমস্ত বিষাদ ভুলে মন ভাল হয়ে ওঠে নীলাদ্রিরও। তবে এই দার্জিলিংই যে ওর জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেবে তা হয়ত স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি নীলাদ্রি। দার্জিলিংয়ে পা দিয়েই নীলাদ্রি ঠিক করেছিল ওর মনের মানুষকে এই স্বপ্নভূমিতেই ও ওর মনের কথা বলবে। আর গোপন নয় এবার নিজের বাস্তবকে অন্তত সমাজের এই ২ টি মানুষের বাস্তবের সামনে তুলে ধরবে ও।

  সেইমত প্রথমদিন সকালেই অসুস্থতার বাহানায় হোটেলে থেকে যায় নীলাদ্রি। নীলাদ্রিকে ছাড়াই ভ্রমণে বেরোয় রৌত্রিক ও তিয়াসা। বিকেলের মধ্যেই হোটেলে ফিরে আসবে ওরা। নীলাদ্রির হাতে কয়েক ঘন্টা মাত্র। সমস্ত পরিকল্পনা হোটেলে আসার সময় গাড়িতেই করে ফেলেছে নীলাদ্রি।  

  রৌত্রিক তিয়াসা বেরিয়ে গেলে হোটেলে বেশ তোড়জোড়ের সঙ্গে নিজের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে মনোনিবেশ করে নীলাদ্রি। হোটেলের একটি ছেলেকে দিয়ে গোলাপের তোরা ও লাল হৃদয়ের বেলুনের প্যাকেট আনিয়ে নেয় ও। যদিও নীলাদ্রি জানে রৌত্রিক ও তিয়াসার ভালোবাসায় অনৈতিক ভাবে হস্তক্ষেপ করার চেষ্টা করছে ও। তবে ও চায় না ওদের মধ্যে কোনও বাধা হয়ে দাঁড়াতে। ও শুধুমাত্র নিজের মনের কথা বলতে চায় ওর মনের মানুষকে। ওর জীবনের সবচেয়ে বড় সত্য জানাতে চায় ও। এতদিনের একান্ত গোপনীয়তার পর্দা সরিয়ে ওর সবচেয়ে কাছের ২ জন মানুষের সঙ্গে ওর সত্য ভাগ করে নিতে চায় ও। 

  সুন্দর ভাবে ঘর সাজিয়েছে নীলাদ্রি। ঘরের আনাচে কানাচে ভালোবাসার প্রতীক হিসাবে খেলে বেড়াচ্ছে লাল বেলুনের দল। নীলাদ্রির ভালোবাসার রঙ যেন মেখেছে নীল আকাশটাও। ডুবন্ত সূর্যের ভালোবাসার ছোঁয়ায় লাল হয়ে উঠেছে আকাশের নীল শরীর। ঠিক যেমন লাল হয়ে উঠেছে নীলাদ্রির গাল দুটো। 

  পাহাড়ের বুকে একান্ত সময় কাটিয়ে বেশ ভাল মনে হোটেলে ফিরেছে রৌত্রিক ও তিয়াসা। তবে হোটেলে ফিরে ঘরে প্রবেশ করেই হতবাক হয়ে যায় ওরা দুজন। নীলাদ্রির হাতে গোলাপের তোরা। ঘর ভর্তি লাল বেলুন। রৌত্রিক এক মুহূর্তেই বুঝে নেয় নীলাদ্রি তিয়াসাকে ভালোবাসা জ্ঞাপন করতে চলেছে। বেশ বিরক্ত লাগতে শুরু করে ওর। ছোটোবেলা থেকে নীলাদ্রির ও সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু হলেও রৌত্রিক মনে মনে নীলাদ্রির প্রতি ঈর্ষান্বিত ছিল বরাবর। প্রথম থেকেই ক্লাসের সবচেয়ে ভাল ছেলের তকমা নীলাদ্রির জন্যই তোলা থাকত। রৌত্রিকের হাজার চেষ্টার পরও সবদিক থেকেই ক্লাসের সেরার তকমা ছিনিয়ে নিত নীলাদ্রি। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকেও রৌত্রিকের থেকে বেশ ভালো ফল করেছে নীলাদ্রি।

 “এবার কি তবে তিয়াসাকেও ছিনিয়ে নিতে চায়……”, রৌত্রিকের ভাবনায় ছেদ পড়ল নীলাদ্রির কথায়। 

“যেদিন থেকে এই মনে–শরীরে ভালোলাগার আকর্ষণ অনুভব করেছি সেদিন থেকেই তোকে আমার ভালোলাগতে শুরু করে। তবে কখনই তা বলে উঠতে পারিনি। কারণ আমি নিজেই দিশাহারা ছিলাম আমার ভালোলাগার বিষয়ে। যেই সময় তোর একাধিক প্রেম সেই সময় বিভ্রান্তের মত খুঁজে বেড়াচ্ছিলাম আমার জীবনের সত্যকে। পরে যখন আমার চোখের সামনে সত্য উন্মোচন হয়। চুপ করে থাকতে বাধ্য হই আমি”। আর কিছু না বলে এক পা এক পা করে রৌত্রিক ও তিয়াসার দিকে এগিয়ে যেতে শুরু করে নীলাদ্রি।

  ততক্ষণে রৌত্রিকের রাগ মাথায় চড়েছে। কিছুতেই ও তিয়াসাকে ওর থেকে ছিনিয়ে নিতে দেবেনা নীলাদ্রিকে। তবে ওদের দুজনকে অবাক করে দিয়ে রৌত্রিকের সামনে গোলাপ নিয়ে বসে পরে নীলাদ্রি। রৌত্রিকের হাতে গোলাপটা তুলে দেয় ও।

“আমি তোকে ভালোবাসিরে, ভালোবাসি আমি তোকে”…… নীলাদ্রির এহন কাণ্ডে হতবাক রৌত্রিক। হাজারো প্রশ্ন ভিড় করে আসছে ওর মনে। তবে রৌত্রিককে প্রশ্ন করতে না দিয়ে রৌত্রিকের স্তম্ভিত চোখে চোখ রেখে ফের বলতে শুরু করে নীলাদ্রি, “হ্যা ঠিকই শুনেছিস আমি তোকে ভালোবাসি। আমি ‘পুরুষপ্রেমী’। সেই ক্লাস নাইন থেকে তোকে আমার ভালোলাগতে শুরু করে। শুধু তুই নস যেকোনও সুদর্শন ছেলেই আমার মন কেড়ে নিতে থাকে। তুই বা অন্যরা যখন নতুন নতুন বান্ধবী বানাতে ব্যস্ত আমার তখন বন্ধুদের শারীরিক বদলের দিকেই ছিল বেশি নজর”। এক নিঃশ্বাসে কথা গুলো বলে একটু থামে নীলাদ্রি। একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে ফের বলতে শুরু করে ও, “তবে জানিস, আমি তখনও এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বেড়াতাম। নারী নয় কেন? তবে এর যখন উত্তর পেলাম তখন রঙিন এই সমাজের অন্ধকার মোড় গুলোও চোখের সামনে স্পষ্ট হতে শুরু করল। আমার সত্যকে মনের অন্দরেই লুকিয়ে রাখলাম আমি”। ফের একটু থামল নীলাদ্রি। ওর চোখের কোন থেকে দু ফোটা জল লাল বেলুনের ওপর পড়ে রঙিন হয়ে উঠল। 

Gay | Gay cops in Rajasthan suspended after a video goes viral dgtl -  Anandabazar

তবে এবার আর নীলাদ্রিকে বলতে না দিয়ে চেঁচিয়ে উঠল রৌত্রিক “তুই তো জানিস আমি তিয়াসাকে ভালোবাসি। আর তুই ‘গে’? কাকু কাকিমা জানেন? তুই জানিস সবাই জানতে পারলে কি হবে?” – ঘৃণা ও তাচ্ছিল্যের স্বরে কথা গুলো বলল রোত্রিক। 

  তবে শান্ত স্বরেই উত্তর দিল নীলাদ্রি, - “দেখ আমি তোর আর তিয়াসার মাঝে কখনই আসতে চাইনা। তোরা আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধু। এতদিন ধরে মনের মাঝে চেপে রাখা সত্যটা কাউকে না বলতে পেরে হাপিয়ে উঠেছিলাম আমি। তাই আজ ভোরে দার্জিলিংয়ে পা দিয়েই নিজের মনের কথা তোদের ২ জনকে জানানোর সিদ্ধান্ত নি আমি। তবে দয়া করে এখনই কাউকে কিছু বলিস না তুই। আমি ভাবতে পারিনি তুই আমার সম্বন্ধে সব জানলে এতটা ঘৃণা করবি আমায়, জানলে আমি তোকে এই পরিস্থিতিতে ফেলতাম না”। 

  নীলাদ্রি হয়ত আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল তবে ওর কথা শেষ না হতে দিয়েই গোলাপের তোড়াটা মেঝেতে ফেলে দিল রৌত্রিক। রোত্রিকের বুটের চাপে লাল গোলাপের পাপড়ি গুলো কালো হয়ে গেল নীলাদ্রির চোখের সামনে। 

  “ছিঃ! তোর সঙ্গে থাকা মানে আমারও বদনাম। কালই আমরা ফেরার ফ্লাইট ধরব”।– কথা শেষ করে ঘর থেকে বেড়িয়ে গেল রৌত্রিক। এতক্ষণ নির্বাক সাক্ষী হয়ে দেখছিল তিয়াসা। এবার রৌত্রিকের পেছন পেছন তিয়াসাও ঘর থেকে বেড়িয়ে গেল। লক্ষাধিক আশঙ্কা মনে নিয়ে সদ্য ঘটে যাওয়া বাস্তব নাটকের রঙ্গমঞ্চে নিশ্চুপ বসে রইল নীলাদ্রি। 

  নীলাদ্রির মনের বিষণ্ণতার ছোঁয়া যেন প্রকৃতির মনেও আঘাত হানল খনিকেই। ঘন কালো মেঘে ছেয়ে গিয়েছে আকাশ। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই সবুজে ঘেরা দার্জিলিং বৃষ্টির চাঁদরে ঢেকে নেবে নিজেকে। 

  বাইরে অবাধে ঝোড়ছে জলের ধারা। তেমনি বাঁধাহীন গতিতে ঝোড়ে চলেছে নীলাদ্রির চোখের জল। পাশের ঘরে রৌত্রিককে কিছু বোঝাচ্ছে তিয়াসা। ও হয়তো বুঝতে পেরেছে নীলাদ্রির পরিস্থিতি। তবে রৌত্রিকের তীব্র ঘৃণা ও তাচ্ছিল্লের সামনে তিয়াসার যুক্তির পথে বাধা হয়ে দাড়াচ্ছে ওর ভালোবাসা। বড্ড ঘুম পাচ্ছে নীলাদ্রির। হাজারো মানসিক চিন্তার ভাড়ে চোখ দুটো টেনে খুলে রাখতে পাড়ছেনা ও।

  পরদিন ভোরে তিয়াসাকে নিয়ে আগেই ফ্লাইট ধরেছে রৌত্রিক। দুজনের কেউই একবারও দেখা করতে আসেনি নীলাদ্রির সঙ্গে। নীলাদ্রির ঘুম ভাঙ্গলে হোটেল বয় ওর হাতে ধরিয়ে দিয়ে গিয়েছে ফ্লাইটের টিকিট। ওর ফ্লাইট বিকেলে।

  সেইদিন সারাদিন কেমন যেন ঘোড়ের মধ্যে কেটেছে নীলাদ্রির। সকাল থেকে রৌত্রিক ও তিয়াসাতো দূরের কথা ওর বাবা মাও একবারও ফোন করেনি ওকে। “তবে কি?”, “রৌত্রিক কি কিছু বলেছে” – বেশ কয়েকটি প্রশ্নবাণ ক্রমেই ওর মনের অন্দরে খোঁচা দিতে শুরু করেছে। নীলাদ্রির চারপাশ ঘিরে বিরাজ করছে এক অদ্ভুদ নিস্তব্ধতা, শুধু তোলপাড় হচ্ছে ওর মন। 

  ওর চারপাশের অদ্ভুদ শান্তি কেমন যেন ঝড়ের পূর্বাভাস বলে মনে হচ্ছে ওর। তবে এবার মনস্থির করে নিয়েছে ও। আর নয় এবার সত্যের জন্য সমাজের মুখোমুখি হতেও প্রস্তুত নীলাদ্রি। ওর নিজের স্বত্বাকে আর সমাজের ভয়ে লুকিয়ে রাখবেনা ও। ভগবান ওকে সৃষ্টি করেছে ওর মত করে। নিজের মত করেই বাঁচবে ও। 

 “আসছি” – কলিং বেলের আওয়াজে দরজার ওপার থেকে মায়ের গলা শুনতে পেল নীলাদ্রি। গলার স্বরটা শুনেই মনে খটকা লেগেছিল নীলাদ্রির। দরজা খুলতেই সবটা স্পষ্ট হয়ে গেল। সোফায় বসে রয়েছে রৌত্রিক। তবে সঙ্গে নেই তিয়াসা। 

  ঘরে ঢুকতেই বাবার গলা কানে এল নীলাদ্রির, “শেষমেশ এইদিন দেখালি কুলাঙ্গার ছেলে। এরপর আর কাউকে মুখ দেখাতে পারব আমরা? কি বলেছিস তুই ওকে, তুই ‘পুরুষপ্রেমী’। তুই কি আদও পুরুষ! এমন কথা পুরুষের মুখে মানায় না। আর যদি একবারও তোর মুখ থেকে এরকম কোনও কথা আমি শুনতে পাই……” 

বাবার চরম শাস্তি ধাহ্য করতে না দিয়েই গর্জে উঠল নীলাদ্রি, – “হ্যা আমি পুরুষ, আমিও পুরুষ। এই সমাজের বুকে রৌত্রিক বা তুমি যতটা পুরুষ, ঠিক ততটাই পুরুষ আমিও। ফারাকটা শুধু এখানেই যে তোমারা আকর্ষিত হও নারীদের প্রতি। আর আমি আকর্ষিত হই পুরুষের প্রতি” – নীলাদ্রির গলায় ঘৃণা ও প্রতিবাদের সুর এতটাই তীব্রতর যে তার সামনে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছে ওর বাবাও – “আর সমাজে প্রকৃত পুরুষের ব্যাখ্যা ঠিক কেমন হবে তা কে ঠিক করে দিয়েছে? পুরুষ মানেই তাকে কঠিন হতে হবে কে জানিয়েছে? নারী বা পুরুষ হয়ে জন্মানোর পর কেন তাকে সমাজ এর বেঁধে দেওয়া নিয়মেই চলতে হবে?  পুরুষ নমনীয় হতে পারবেনা কেন? পুরুষ শাড়ি পড়তে পারবেনা কেন? পুরুষ যদি নিজেকে সাজিয়ে তুলতে চায় সুগন্ধী দ্রব্যে, রকমারি রঙের স্পর্শে তাতে দোষ কোথায়? এরফলে সে পুরুষ থাকবে না কেন?” 

 নীলাদ্রির একের পর এক প্রশ্ন বাণের জবাব খুঁজে পাচ্ছেনা ওর বাবাও। তবে নীলাদ্রি এখনও সরব, “কেন প্রত্যেককে মানুষ হিসাবে দেখা হবে না? কেন তার গুন গুলো দেখা হবে না? সমাজ কি বলবে সেই ভয়ে কেন নিজেকে লুকিয়ে রাখতে হবে? কেন নারী পুরুষের ভেদে মানুষ ওপরে নয়? কেন প্রথা ভাঙে পুরুষ নমনীয় হলেই তাদের নারী বলে কটাক্ষ করা হবে?” তারাও পুরুষ, আমিও পুরুষ”। 

  নীলাদ্রির দাপটে বয়ে চলা তীব্র ঝড়ের পর ফের একটু শান্ত হয়ে উঠেছে নীলাদ্রিদের বসার ঘর। নীলাদ্রির প্রশ্নের জবাব খুঁজে চলেছেন ওর বাবা। একপাশে নিশ্চুপ বসে রয়েছে রৌত্রিক। ছেলের দিকে তাকিয়ে এখনও দাঁড়িয়ে রয়েছেন নীলাদ্রির হতবাক মা। সকলের ঘোর কাটল ফোনের শব্দে। নীলাদ্রির ফোনে ম্যাসেজ ঢুকেছে। ফোনটা হাতে নিয়ে ম্যাসেজটা সিন করে দরজার দিকে তাকালো ও। দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে রয়েছে তিয়াসা। কারোর কোনও অনুমতির অপেক্ষা না করেই ছুটে এসে নীলাদ্রিকে জড়িয়ে ধরলো ও। দুই জনেই নিশ্চুপ।

  নীলাদ্রির চোখের জলে ভেসে যাচ্ছে তিয়াসার কাঁধ। ঘর থেকে বেড়িয়ে গিয়েছে রৌত্রিক। তিয়াসার এই অসহ্য নাটক আর পছন্দ হচ্ছে না ওর। নীলাদ্রিকে তিয়াসার সমর্থন মূল্যহীন ওর কাছে। সদ্য ঘটে যাওয়া ঝড়ের দাপটে মাটিতে বসে কাঁদছেন নীলাদ্রির মা। এখনও নির্বাক ওর বাবা।   নীলাদ্রির হাতের স্পর্শে ওর ফোনের ম্যাসেজ বক্সে বারংবার আলকিত হয়ে উঠছে তিয়াসার ম্যাসেজটা – “হ্যা তুইও পুরুষ”।