নিজস্ব প্রতিনিধি, ঝাড়গ্রাম : আপনার কোনও গুরুত্বপূর্ণ জিনিস হারিয়ে গিয়েছে? অনেক খুঁজেও পাচ্ছেন না? সেই বস্তু ফিরে পেতে চাইলে আপনাকে আসতেই হবে ঝাড়গ্রামে। এই শহর থেকে ১৭ কিলোমিটার দূরে রয়েছে গুপ্তমনি মন্দির। স্থানীয়দের বিশ্বাস ওই মন্দিরে পোড়া মাটির ঘোড়া বা হাতি সুতো দিয়ে বেঁধে মানত করলেই পাওয়া যায় হারানো বস্তু। এটা হল স্থানীয় বিশ্বাস,, কিন্তু এই মন্দির কোনও অংশেই কম ঐতিহাসিক নয়।
দেবী দুর্গার রূপেই পূজিতা হন মা গুপ্তমনি। মূলত আদিবাসী শবর জাতির আরাধ্যাদেবী। ইতিহাস বলে, প্রায় সাড়ে সাতশো বছরের পুরোনো এই মন্দির। দেবীর ইচ্ছায় আজও এখানে পাকা ছাদ হয়নি। টিনের ছাউনি দেওয়া পাকা দেওয়াল, ছোট্ট পরিসরে পাথরের মূর্তি। আজও এই মন্দির সন্ধ্যার পর নিমজ্জিত হয় গাড় অন্ধকারে। কোনও আলো জ্বালানো হয় না, এমনকি প্রদীপও। এই মন্দির ব্রাহ্মণ্যবাদের বাইরে গিয়ে হতদরিদ্র আদিবাসীদের হাতই পূজিতা হন দেবী। প্রাচীন রীতি মেনে গুপ্তমনি মায়ের পুজো করেন শবর সম্প্রদায়ের মানুষজন। কোনও ব্রাহ্মণ পুজো করেন না, দুর্গাপুজোয় হয় না চন্ডীপাঠ, গীতাপাঠ বা যজ্ঞ। তবে বলি প্রথা আছে, নবমী ও দশমী তিথিতে বলি হয়। তবে এখন দুর্গাপুজোয় প্রচুর লোকসমাগম হয়। অন্যান্য জেলা থেকেও প্রচুর ভক্ত আসেন গুপ্তমনি মন্দিরে পুজো দিতে।
গুপ্তমনি মন্দিরের ইতিহাস যেমন সুপ্রাচীন তেমনই এই মন্দিরের প্রতিষ্ঠা নিয়েও রয়েছে জনশ্রুতি। কথিত আছে, ১২৭২ সাল নাগাদ ঝাড়গ্রামের তৎকালীন রাজা রঘুনারায়ণ মল্লদেবের প্ৰিয় হাতি হারিয়ে যায়। রাজা তাঁর হাতি খুঁজতে দিকে দিকে লোক পাঠান। কিন্তু অনেক খুঁজেও সেই হাতি পাওয়া যায়নি। এরপর রাজা একদিন স্বপ্নে দেবীর দর্শন পান। তিনি নির্দেশ দেন কাছেই সুখনিবাসা জঙ্গলে তাঁর হাতি বাঁধা আছে। এই সুখনিবাসা ছিল রাজা মল্লদেবের গুপ্ত রাস্তা। ওই একই সময়ে স্থানীয় শবর সম্প্রদায়ের নন্দ ভক্তা সেখানে একটি পাথরের মূর্তি উদ্ধার করে দেবী রূপে সেবা করতেন। রাজা স্বপ্নাদেশ পেয়ে লোক লস্কর নিয়ে সুখানিবাসা পৌঁছান। গিয়ে দেখেন তাঁর প্ৰিয় হাতি লতাপাতা দিয়ে বাঁধা আছে। কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও রাজা তার হাতিকে উদ্ধার করতে পারে না। এরপর নন্দ ভক্তা রাজার আদেশে বেলপাতা ও তুলসী দিয়ে মায়ের পুজো করলে সেই হাতি মুক্ত হয়। সেই থেকে আজও শবর সম্প্রদায়ের লোকজনই গুপ্তমনি মায়ের পুজো করে আসছেন। আজও সেই প্রাচীন প্রথা মেনে এখানে পুজো হয়।
কলকাতা থেকে মুম্বইগামী ৬ নম্বর জাতীয় সড়কের ধারে মা গুপ্তমনির মন্দির। ঝাড়গ্রাম শহর থেকে দূরত্ব ২৭ কিলোমিটার আর খড়গপুর থেকে মাত্র ১৪ কিলোমিটার। অতি সাধারণ টিনের চালের এই মন্দিরের গায়ে অসংখ্য পোড়া মাটির ছোট্ট ছোট্ট হাতি ঘোড়ার মূর্তি বাঁধা। এছাড়া অনেকেই নতুন কেনা গাড়ি বা বাইক নিয়ে এখানে পুজো দিতে আসেন। স্থানীয়দের বিশ্বাস, মা গুপ্তমনি দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা করেন। এই অবাক করা মন্দির ও প্রাচীন রীতিনীতিতে অনুষ্ঠিত মা গুপ্তমনির পুজো দেখতে আপনিও আসতে পারেন দুর্গাপুজোর সময়।