নিরপেক্ষ নির্বাচনে এক ধাপ এগোল আওয়ামী লীগ

নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা নিয়ে বিএনপি আলোচনা করতে পারে। যদি তাদের নির্বাচনের অংশ নেয়ার  পরিকল্পনা থাকে। কারণ সিটি কর্পোরেশন  নির্বাচনের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ বিএনপির বিকল্প  খুঁজে নিয়েছে।

author-image
Pritam Santra
New Update
awami league

জুয়েল রাজ, লন্ডন:  গাজীপুর সিটি নির্বাচন দিয়ে শুরু করে  বরিশাল ও খুলনার নির্বাচনের ফলাফল ও সার্বিক নির্বাচন ব্যবস্থার মাধ্যমে আগামী জাতীয় নির্বাচনে এক ধাপ এগিয়ে গেল,  সরকারী ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। বাংলাদেশের আগামী ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনের আগাম পরীক্ষায় পাশ করেছে আওয়ামী লীগ সরকার। নির্বাচন পরবর্তী  এক প্রতিক্রিয়ায় সরকারের তথ্যমন্ত্রী ও দলটির প্রভাবশালী যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক  ড: হাছান মাহামুদ একটি গুরুত্বপূর্ণ  মন্তব্য করেছেন। তিনি  বলেছেন, বিএনপি ভোট বর্জন করলেও জনগণ ভোট বর্জন করেনি তিনি বলেন, সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বরিশালে ৫০ শতাংশের বেশি আর খুলনায় ৫০ শতাংশের কাছাকাছি ভোট পড়েছে। এতে প্রমাণ হয়েছে, বিএনপি ভোট বর্জন করলেও জনগণ ভোট বর্জন করেনি। এ থেকে বিএনপিকে শিক্ষা নিতে পরামর্শ দেন তিনি।

নির্বাচন নিয়ে বিএনপি এখন যে জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে,  তত্ত্ববধায়ক সরকার ব্যবস্থা ছাড়া আওয়ামী লীগের অধীনে দলটি কোন  নির্বাচনেই যাবে না। সেটি  তাদের জন্য বুমেরাং হবে। আপাত দৃষ্টিতে এবং বাংলাদেশের সার্বিক রাজনৈতিক  পরিস্থিতি বিবেচনা করলে,  তত্ত্ববধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরে আসার বিন্দুমাত্র  সম্ভাবনা  আর নাই। বিএনপি কে নির্বাচনে আসলে,  শেখ হাসিনার  অধীনেই নির্বাচনে অংশ নিতে হবে। বরং নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা নিয়ে বিএনপি আলোচনা করতে পারে। যদি তাদের নির্বাচনের অংশ নেয়ার  পরিকল্পনা থাকে। কারণ সিটি কর্পোরেশন  নির্বাচনের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ বিএনপির বিকল্প  খুঁজে নিয়েছে। বিএনপি যদি  গোঁ ধরে তাদের অবস্থান ধরে রাখে,  জাতীয় পার্টি এবং ইসলামী ঐক্যজোট  বিএনপির বিকল্প হিসাবে হয়তো আগামী নির্বাচনে ৩০০ আসনেই তাদের প্রার্থী দিবে। এবং বিএনপির সমর্থক এবং আওয়ামী বিরোধী  ভোটাররাই  তাঁদের ভোট দিবে। কারণ ইসলামী ঐক্যজোট  বিএনপির ভিতর থেকেই জন্ম নেয়া ও বের হয়ে আসা সংগঠন । 

awami league

বরিশাল এবং খুলনার সিটি নির্বাচনে ভোটের হিসাব যদি দেখি, নৌকা প্রতীকের প্রার্থী আবুল খায়ের আবদুল্লাহ পেয়েছেন ৮৭ হাজার ৮০৮ ভোট। দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা হাতপাখা প্রতীকের প্রার্থী পেয়েছেন ৩৩ হাজার ৮২৮ ভোট। তৃতীয় হওয়া স্বতন্ত্র প্রার্থী কামরুল আহসান ৭ হাজার ৯৯৯ ভোট পেয়েছেন। জাতীয় পার্টি পেয়েছে ৬ হাজারের সামান্য বেশী ভোট। আওয়ামী লীগের বিপক্ষে  ভোট পড়েছে প্রায় ৪৮ হাজার।  খুলনার ৫ লাখ ৩৫ হাজার ৫২৯ ভোটের মধ্যে তালুকদার খালেক পেয়েছেন ১ লাখ ৫৪ হাজার ৮২৫ ভোট। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী হাতপাখা প্রতীক নিয়ে ইসলামী আন্দোলনের মোঃ আব্দুল আউয়াল পেয়েছেন ৬০ হাজার ৬৪ ভোট।

ইসলামী ঐক্যজোট সাংগঠনিক  ভাবে কি জাতীয় পার্টি বা অন্য কোন ছোট রাজনৈতিক দলের চেয়ে বাংলাদেশের জাতীয় রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার করার ক্ষমতা রাখে?  অথবা ৫০ /৬০ হাজার ভোট পাওয়ার মত রাজনৈতিক  কর্মী সমর্থক কি তাদের আছে? এক কথায় উত্তর দিলে সেই সক্ষমতা ইসলামী ঐক্যজোটের নেই। তাহলে এই ভোট কোথা থেকে আসলো! আওয়ামী লীগ নিশ্চয় হাতপাখা মার্কায় ভোট দেয় নি।  জ্বীন ভূত এসে ও লাইনে দাঁড়িয়ে  ভোট দেয় নাই। তার মানে আওয়ামী লীগের বিপক্ষে যাদের রাজনৈতিক অবস্থান  বিএনপি, জামায়াত ইসলাম এবং ইসলামী ঐক্যজোটের  সমর্থকরাই এই ভোট দিয়েছেন। সেই হিসাবটি পরিস্কার।  

ইতিহাস বলে, ইসলামী ঐক্যজোটের যাত্রা শুরু হয় ১৯৯০ সালের ২২ ডিসেম্বর। ১৯৯১ সালে বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে মূলত এই দলটি গঠন করা হয়েছিল। এবং ইসলামী ঐক্যজোট ১৯৯১ সালের সাধারণ নির্বাচনে নিজস্ব প্রতীক মিনারে নির্বাচন করে সিলেটের জকীগঞ্জ-কানাইঘাট আসন থেকে মাওলানা উবায়দুল হক সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। 

১৯৯৬ সনের নির্বাচনে বরগুনা-২ আসন (পাবনা -পাথরঘাটা ) থেকে ইসলামী ঐক্যজোটের প্রার্থী গোলাম সরওয়ার হিরু সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তাছাড়া ২০০১ সালের সাধারণ নির্বাচনে ইসলামী ঐক্যজোটের মনোনীত ও চার দলীয় প্রার্থী হিসেবে ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ (সরাইল) আসন থেকে মরগুম মুফতি ফজলুল হক আমিনী, যশোর-৫ (মণিরামপুর) আসনে থেকে মুফতি মুহাম্মাদ ওয়াক্কাছ, নড়াইল-২ আসন থেকে মুফতি শহিদুল ইসলাম ও সুনামগঞ্জ থেকে মাওলানা শাহীনুর পাশা চৌধুরী সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। শেষোক্ত দু’জন উপ-নির্বাচনে নির্বাচিত হয়েছিলেন। উল্লেখ্য ১৯৯১ সালের নির্বাচনে ইসলামী ঐক্যজোট প্রার্থী মাওলানা ওবায়দুল হক প্রাপ্ত ভোট ছিল ২৬ হাজারের সামান্য বেশী। 

awami league

১৯৯৯ সালের জানুয়ারি মাসে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে বিএনপি চারদলীয় জোট গঠন করেছিল যাতে ইসলামী ঐক্যজোট ছিল। তৎকালীন ছয়টি ইসলামি দল নিয়ে গঠন করা হয় এই জোট। দলগুলো হচ্ছে- খেলাফত মজলিস, খেলাফত আন্দোলন, নেজামে ইসলামী পার্টি, ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন (বর্তমান ইসলামী আন্দোলন), জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম ও ফরায়েজী আন্দোলন। জোট গঠনে মুখ্য ভূমিকা পালন করেন শায়খুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হক, চরমোনাইর পীর মাওলানা ফজলুল করিম, মাওলানা আবদুল করিম শায়খে কৌড়িয়া, মাওলানা আশরাফ আলী ধর্মান্ডুলি, মাওলানা মুহিউদ্দিন খান ও মাওলানা আহমাদুল্লাহ আশরাফ।ইসলামী ঐক্যজোট মূলত বাংলাদেসগে  ইসলামী শাসন ব্যবস্থার স্বপ্ন দেখে।

সর্বশেষ ঢাকায় চলতি বছরের জানুয়ারী মাসে তারা একটি মিছিল ও  সমাবেশ করেছিল সেই সমাবেশে,  ৯২ ভাগ মুসলমান দেশের পাঠ্যপুস্তকে ইতিহাসের সঠিক উপস্থাপন দেখতে চায় জনগণ বলে দাবি করেছেন ইসলামী ঐক্যজোটের নেতারা। শিক্ষা সিলেবাসকে ইসলাম বিরোধী দাবি করে অবিলম্বে তা বাতিল করার আহ্বানও জানিয়েছিল।

 মিছিল পূর্ব সমাবেশে সভাপতির বক্তব্যে ইসলামী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান মাওলানা আবুল হাসানাত আমিনী বলেন, বিতর্কিত শিক্ষা সিলেবাসের মাধ্যমে দেশের নতুন প্রজন্মকে নাস্তিক বানানোর ষড়যন্ত্র চলছে। পাঠ্য বইয়ে মুসলিম শিক্ষার্থীদের ঈমানহারা করার পাঁয়তারা চলছে।

তিনি বলেন, অবিলম্বে ইসলামবিরোধী বিতর্কিত শিক্ষা সিলেবাস অবিলম্বে বাতিল করতে হবে। বিরানব্বই ভাগ মুসলমানের চিন্তা চেতনা অনুযায়ি আলেমদের তত্বাবধানে নতুন শিক্ষা সিলেবাস প্রণয়ন করতে হবে। একই সঙ্গে এই সিলেবাস প্রণয়নে অভিযুক্তদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে।

এই পুরনো আলোচনার মূল যে কারণ, বাংলাদেশের রাজনীতি  মূলত দুই ভাগে বিভক্ত।  একপক্ষে আওয়ামী লীগ আর অন্যপক্ষে আওয়ামী বিরোধী।  এর মাঝখানে যে শত শত রাজনৈতিক  দল সমূহ নামে বেনামে রাজনীতির মাঠে খেলছেন তারা আসলে  ঐ পক্ষ সমূহের সহযোগী খেলোয়াড়।  গাজীপুর, খুলনা বরিশাল  সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে বড় ধরণের কোন অভিযোগের সংবাদ এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি।  কোন গণমাধ্যমে অনিয়মের কোন অভিযোগ বা সংবাদ আসে নাই। দক্ষিণ এশিয় নির্বাচনী সংস্কৃতিতে  বিশেষ করে বাংলাদেশের নির্বাচনে যে সব হতাহত, সন্ত্রাস, অস্ত্রের মহড়া বা প্রভাব বিস্তার করার সংস্কৃতি ছিল, সেই জায়গা থেকে বের হয়ে এসেছে বলেই ধারণা করা  যায়। নির্বাচন কমিশন এবং সরকার, দুই পক্ষই নিরপেক্ষতা  প্রমাণের এবং  অংশগ্রহণ মূলক সুষ্ঠ নির্বাচনের নিশ্চয়তা দিতে সক্ষম হয়েছে। 

আগামী জাতীয় নির্বাচন নিয়ে দেশী বিদেশী মহলে যে উদ্বেগ ও রাজনীতি  চলছে, সেই রাজনীতির আগুনে পানি ঢেলে দিয়েছে এই নির্বাচন। আর এর মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগের  অধীনে নিরপেক্ষ সুষ্ঠু  নির্বাচনের পথে এক ধাপ এগিয়ে গেল আওয়ামী লীগ।  

এখন বিএনপি কে সিদ্ধান্ত নিতে হবে তারা আগামী নির্বাচনে শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করবে কী না। অন্যতায় আওয়ামী বিরোধী শক্তি যারা বিএনপির নেতৃত্বে  রাজনীতি করে আসছে তাদের বৃহৎ দুইটি অংশ হচ্ছে জামায়াত ইসলাম ও ইসলামী ঐক্যজোট।  জামায়াত ইসলাম বাংলাদেশে রাজনীতি করবে কী করবে না সেই আলোচনা ভীন্ন।  আমি ব্যাক্তিগত ভাবে, আদর্শিক ভাবে কোনদিন ও চাই না জামায়াত আবার বাংলাদেশের রাজনীতিতে  পুনর্বাসন হউক।  আইনি ভাবে যদিও দলটি নিষিদ্ধ  নয়। সেই সুযোগকেই হয়তো  বাজির তাস, হিসাবে খেলতে চাইছে আওয়ামী লীগ।   ইঞ্জিনিয়ার ইনিস্টিউটে দীর্ঘ ১৪ বছর পর আনুষ্ঠানিক কোন সমাবেশ করেছে  জামায়াত ইসলাম। এবং সরকারের আশীর্বাদেই সেটি করতে সক্ষম হয়েছে,  এই বিষয়টি সাধারণ  মানুষ খুব সহজেই অনুমান করতে পারেন।  একটি অংশগ্রহণ মূলক নির্বাচন বিএনপি কে বাদ দিয়ে ও করা সম্ভব। এবং আওয়ামী লীগ হয়তো সেই পথেই হাঁটছে।