প্রশাসন ব্যবস্থা নেয়নি ! কেউ স্বামী হারা, কেউ বা সন্তান, চোলাই ভাটি ভাঙতে জোট বাঁধলেন মহিলারা

আবগারি দপ্তর মাঝে মধ্যে এসে অভিযান চালিয়ে ফিরে যান।

author-image
Adrita
New Update
s

নিজস্ব সংবাদদাতাঃ " আধুনিক সভ্যতার বাহন তোরা—তোরা মর্‌। কিন্তু যে নির্মম সভ্যতা তোদের এমনধারা করিয়াছে তাহাকে তোরা কিছুতেই ক্ষমা করিস না। যদি বহিতেই হয়, ইহাকে তোরা দ্রুতবেগে রসাতলে বহিয়া নিয়া যা। " শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বেদনায়, ক্ষোভে এমনই লিখেছেন তাঁর উপন্যাসে। যেখানে দেখা গিয়েছে, মদ্যপ অবস্থায় নর-নারীরা শুয়ে রয়েছে। কেউ উদ্দাম নৃত্যে মত্ত। যেখানে তৃষ্ণার জলটুকু নেই পরিবারে। কিছুটা এমনই চিত্র উঠে এলো মেদিনীপুর সদর ব্লকের চাঁদড়া গ্রাম পঞ্চায়েতের খড়িকাশুলি লোধা অধ্যুষিত গ্রামে। এই গ্রামে ৩০ থেকে ৩৫ টি চোলাই ভাটি রয়েছে। যেখানে সকাল থেকে রাত বাড়ির পুরুষেরা মত্ত হয়ে ওঠে চোলাই মদের নেশায়। রাতেও বাড়ি ফিরে না অনেকে। রেশনের চাল, বাড়ির নতুন জামা-কাপড়, থালা-বাসন, আসবাবপত্র, এমনকি গবাদি পশুও তারা বিক্রি করে ফেলছে নেশার খরচ জোগাতে। সংসার চালাতে উপার্জনের কোন চিন্তা নেই তাদের। পরিবারের মহিলারা সকাল হলেই সন্তানদের কোন রকমে দুমুঠো খাইয়ে রুজি-রোজগারের সন্ধানে বেরিয়ে পড়ে। অনেকে জঙ্গলের কাঠপাতা কুড়িয়ে জীবিকা নির্বাহ করে। কেউ আবার অন্যের কৃষি জমিতে কাজ করে। অসহায় অবস্থায় দিন কাটছে তাদের। তারপরও যখন মদ্যপ অবস্থায় এসে স্বামী মারধর করে তখন অত্যাচারের সীমা পেরিয়ে যায়। বছরের পর বছর এমন অত্যাচার সহ্য করতে করতে এখন তাঁদের দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গিয়েছে।  এখান থেকেই তারা শুরু করছে ঘুরে দাঁড়ানোর লড়াই। অনেকে বলছেন, জেলাশাসক বিভিন্ন লোধা-শবর গ্রামে গিয়ে পাশে থাকার আশ্বাস দিয়েছেন। এই গ্রামেও আসুক জেলা প্রশাসন। তাদের অসহায় অবস্থার কথা দেখে সমাধানের চেষ্টা করুক। তাদের দাবি, চোলাই মদ বন্ধ করতে হবে। তাদের অভিযোগ, প্রশাসন কোন ব্যবস্থা নেয়নি। আবগারি দপ্তর মাঝে মধ্যে এসে অভিযান চালিয়ে ফিরে যান। কিছুই বদলায়নি পরিস্থিতির। এবার অত্যাচারিত, নিপীড়িত মহিলারা জোট বাঁধল। রবিবার সকাল থেকে মহিলারা চোলাই কারবারিদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে বলে এলেন চোলাই মদের ঠেক বন্ধ করতে হবে পাঁচ দিনের মধ্যে। নাহলে নিজেরাই ভেঙে গুঁড়িয়ে দেবেন।

এই গ্রামে দুশোর অধিক পরিবারের বসবাস। তার মধ্যে অধিকাংশই লোধা সম্প্রদায়ের। গ্রামে রয়েছে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়। সেখানেও নাকি মদ, গাঁজার আসর বসে। স্কুলের দিদিমণিদেরও শুনতে হয় নানা কটুক্তি। এমনই অভিযোগ গ্রামের মহিলাদের। স্থানীয় মহিলা বাসন্তী দোলই, দিপালী দোলই, সুবোধা মল্লিকরা বলেন, "মদ খেয়ে স্বামী বাড়ির জিনিসপত্র নিয়ে গিয়ে বিক্রি করে দিচ্ছে। দিনমজুর খেটে নতুন শাড়ি বা জামা কাপড় কিনলে তাও বিক্রি করে দিচ্ছে। ঘরের বাসনপত্র, গবাদি পশু কিচ্ছু রাখছে না। বিক্রি করতে বাধা দিলে মারধর করছে। স্বামীর অত্যাচারে অনেকের মাথা ফেটেছিল। প্রতিদিন পরিবারে অশান্তি। ছেলেমেয়েদের পড়াশোনাও হচ্ছে না। সারাদিন পরিশ্রম আর অশান্তির জেরে আমরা অসুস্থ। টাকার অভাবে সেভাবে চিকিৎসাও করাতে পারছি না। সেই অত্যাচারের প্রতিবাদে জোট বেঁধে এলাকার প্রত্যেকটি মদ ভাটিতে গিয়ে বন্ধ করার জন্য পাঁচদিনের সময় দেওয়া হয়েছে।" তবে বন্ধ না করলে ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়ারও হুঁশিয়ার দিয়েছেন মহিলারা। শুধু বাড়ির জিনিসপত্র বিক্রি করা নয়। কেউ অল্প বয়সে স্বামী হারা হয়েছেন, কেউ আবার তার সন্তানকে হারিয়ে শোকে কাতর। এমনই বছর ২৫ এর জানকি ভক্তা বলেন, "স্বামী সকাল থেকে মদে ডুবে থাকতো। বাড়ি ফিরতো না রাতেও। খাবার না খেয়ে সারাদিন মদ খেয়ে মারা গিয়েছে। দুটো বাচ্চা নিয়ে কিভাবে সংসার চালাবো ভাবতে পারছি না। প্রশাসন ব্যবস্থা নিক সমস্ত চোলাই ভাটিগুলো বন্ধ করার। " তবে পাল্টা হুঁশিয়ারি দেওয়ার অভিযোগ চোলাই কারবারিদের। কারও ক্ষমতা নেই আমাদের মদ দোকান বন্ধ করে দেওয়ার। পুলিশ-প্রশাসন অনেকবার অভিযান চালিয়েছে পারেনি। এমনই নাকি হুঁশিয়ারি দিয়েছে চোলাই কারবারিরা, অভিযোগ মহিলাদের। চাঁদড়া গ্রাম পঞ্চায়েতের উপপ্রধান তারকনাথ বেরা বলেন, "প্রশাসন ব্যবস্থা নিক আইন অনুযায়ী।" সারা ভারত মহিলা ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের জেলা সম্পাদিকা ঝর্ণা জানা ওই মহিলাদের অভিনন্দন জানিয়ে পাশে থাকার বার্তা দিয়ে বলেন, "যেভাবে নারী শিশুর উপর অত্যাচার হচ্ছে তার প্রধান কারণ মাদকদ্রব্য। সরকার এই মাদক প্রসারে উৎসাহ দিচ্ছে। এর বিরুদ্ধে দুর্বার আন্দোলন চারিদিকে গড়ে উঠছে। প্রশাসনের উচিত দ্রুত ওইসব ভাটিগুলো ভেঙে ফেলা। "

Add 1