রজনীগন্ধা ফুল চাষের সহজ পদ্ধতি

author-image
Harmeet
আপডেট করা হয়েছে
New Update
রজনীগন্ধা ফুল চাষের সহজ পদ্ধতি

নিজস্ব সংবাদদাতাঃ রজনীগন্ধা এক সুমিষ্ট সুগন্ধযুক্ত ফুল। জুন বা জুলাই মাসের শুরুর দিকটিই রজনীগন্ধার গাছ লাগানোর সঠিক সময়। রজনীগন্ধা গাছের 'বাল্ব' কিনতে পাওয়া যায়। সেগুলি জানুয়ারি বা ফেব্রুয়ারি মাসের মধ্যে লাগাতে হয়। আর তা নাহলে নার্সারিতেই চারাগাছ কিনতে পাওয়া যায়। আগস্ট মাস থেকে অর্থাৎ মোটামুটি শীতের শুরুর দিকেই গাছটিতে ফুল ফুটতে শুরু করবে। এই কয়েকটা মাস গাছটির খুব ভালোভাবে পরিচর্যা করতে হবে তাহলেই প্রচুর ফুল হবে। রজনীগন্ধা ফুল চাষের জাত

ফুলের পাঁপড়ি বা স্পাইকের সারি অনুযায়ী রজনীগন্ধা তিন ভাগে বিভক্ত। যা হল, সিঙ্গেল, সেমি-ডাবল ও ডাবল। যেসব জাতের ফুলের পাঁপড়ি বা স্পাইক একটি সারিতে থাকে সে সব জাতগুলি সিঙ্গেল শ্রেনীভুক্ত। যে সব জাতে ফুলের পাঁপড়ি দুই বা তিন সারিতে থাকে সেই জাতগুলিকে বলে সেমি-ডবল এবং তিন-এর অধিক পাঁপড়ির সারি থাকলে সেই জাতগুলিকে ডাবল শ্রেনীর আওতাভুক্ত হিসেবে ধরা হয়ে যায়।  রজনীগন্ধা ফুল চাষের প্রয়োজন আর্দ্র আবহাওয়া এবং গড় তাপমাত্রা ২০০ থেকে ৩০০ সে. হওয়া দরকার। পর্যাপ্ত সূর্যোলোকসহ উপকূলীয় এলাকা ও বর্ষাকাল উৎপাদনের উপযুক্ত সময়। শীতকালে রজনীগন্ধা ফুলের উৎপাদন কমে যায়। তবে সেমি ডবল ও ডবল জাত শীতকালেও ফুল দিতে থাকে। রজনীগন্ধা ফুল চাষের জন্য মাটি সুনিষ্কাশন ক্ষমতাসম্পন্ন হতে হবে। দোআঁশ ও বেলে মাটি রজনীগন্ধা চাষের জন্যে উপযুক্ত। মাটির pH ৬.৫-৭.৫ থাকা দরকার। এটি বৃদ্ধির জন্য আদর্শ মান। রজনীগন্ধা ফুল চাষের জমি নির্বাচনে জৈবসার সমৃদ্ধ দো-আঁশ মাটি-ই প্রয়োজন। উঁচু ও মাঝারি উঁচু জমি, জল বের করে দেওয়ার জন্য উপযুক্ত। জলসেচ ব্যবস্থা আছে এবং জমির pH এর মান ৬.৫-৭.৫ আছে এমন জমিই নেওয়া উচিত। রজনীগন্ধা ফুল চাষের জমিতে লাঙল ও মই দিয়ে চাষ করে, মাটি গুঁড়ো করে দৈর্ঘ্যে ৪ মিটার ও প্রস্থে ৩ মিটার জমি কয়েকটি কেয়ারিতে ভাগ করে যাতে দু’সারির কেয়ারির মাঝে জলসেচ বা জল নিকাশের নালা থাকবে। প্রত্যেক কেয়ারিতে ২-৩ সেমি. পুরু করে গোবর সার বা কম্পোষ্ট ছড়িয়ে দিয়ে কোদাল দিয়ে ভালো করে মাটির সঙ্গে ঝুরঝুরে করে নিতে হবে। এবার কাঠা প্রতি ১ কেজি ইউরিয়া ও ১ কেজি মিউরেট অব পটাশ সার দিয়ে উপরের ১৫ সেমি. মাটির সঙ্গে ভালোভাবে মিশিয়ে ফেলতে হবে। এ সমস্ত কাজ চারা লাগাবার অন্তত ১৫ দিন আগে সেরে ফেলতে হবে। রজনীগন্ধা, বীজ ও কন্দ উভয় মাধ্যমেই বংশবিস্তার করে থাকে। তবে আমাদের দেশে সাধারণত কন্দ দ্বারাই রজনীগন্ধার চাষ হয়ে থাকে। প্রতিটি গাছের গোড়ায় পেঁয়াজের মত যে বাল্ব পাওয়া যায় তাকে কন্দ বা বাল্ব বলে। পুরাতন গাছের গোড়ায় ঝাড় আকারে অনেক বাল্ব থাকে। মাঝের বাল্বটি আকারে বড় হয়। সাধারনত মাঝারি থেকে বড় আকারের বাল্ব বংশবিস্তারের জন্য ব্যবহার করা হয়। বড় ধরনের বাল্ব থেকে স্বাস্থ্যবান গাছ হয় ও গাছে তাড়াতাড়ি ফুল আসে। কিন্তু ছোট বাল্ব থেকে দূর্বল প্রকৃতির গাছ হয় ও দেরীতে ফুল আসে। কন্দ থেকে উৎপন্ন গাছে, মা-গাছের সব বৈশিষ্ট্য অক্ষুন্ন থাকে এবং স্বল্প সময়ে গাছে ফুল আসে। শীতকালে কন্দগুলি সাধারণত মাটির নিচে সুপ্ত অবস্থায় থাকে। শীতের শেষে কন্দগুলি লাগানোর জন্য উপযোগী হয়। পুরোনো রজনীগন্ধার ঝাড় ওঠালে গোড়ায় থোকা থোকা পেঁয়াজের মতো দেখতে পাওয়া যায় যাকে কন্দ বা গেঁড় বলা হয় এবং এগুলো থেকেই চারা তৈরি হয়। শীতকালে এ কন্দগুলো সুপ্ত অবস্থায় থাকে যা লাগানোর মাসখানেক আগে তুলে ছায়ায় রেখে দিয়ে মোটা কন্দগুলো বেছে নিয়ে লাগাতে হয়। জমি চাষ শেষ হলে ৫ ফুট প্রশস্ত বেড তৈরি করতে হবে। বেড তৈরির ৭ থেকে ১০ দিন পর কন্দ রোপণ করা উচিত। ০.৬ থেকে ১.১৮ ইঞ্চি ব্যাসের কন্দ লাগাতে হবে। সারি থেকে সারির দূরত্ব ১২ ইঞ্চি এবং কন্দ হতে কন্দের দূরত্ব ৮ ইঞ্চি। কন্দকে ৬ ইঞ্চি গভীরে লাগাতে হবে। কন্দ রোপণের আগে কন্দের সুপ্তাবস্থা (যে সময়টুকুতে বীজ গজাবে না তাকেই সুপ্তাবস্থা বলে) কাটানোর জন্য কন্দ গুলোকে ৪ শতাংশ 'থায়ো-ইউরিয়া' জলীয় দ্রবনে প্রায় ৩০ মিনিট চুবিয়ে রাখতে হবে।

জমি তৈরি এবং সার প্রয়োগের ক্ষেত্রে প্রথমে চাষের সঙ্গে প্রতি বিঘা জমিতে ৩ টন জৈবসার বা খামারের সার মিশাতে হবে এবং ৪-৫ বার গভীরভাবে চাষ দিয়ে অগাছামুক্ত করতে হবে ও জমির মাটি ঝুরঝুরে ও সমান করতে হবে। শেষ চাষের আগে প্রতি বিঘাতে ১৪:২৮:২৮ ইউরিয়া, টিএসপি,এমপি সার মূল সার হিসাবে জমিতে মিশতে হবে। এঁটেল মাটিতে ১০% সার কম দিলেও চলে। ২ মাস পর প্রতি ২ মাস অন্তর ৭ কেজি ইউরিয়া উপরি প্রয়োগ করতে হবে। জমি তৈরীর কাজ চারা লাগাবার অন্ততঃ ১৫ দিন আগে শেষ করতে হবে। তবে টবে চাষের ক্ষেত্রে ২ ভাগ মাটি, ১ ভাগ পাতা পচা সার, ১ ভাগ পচা গোবর সার মিশিয়ে টব ভরে নিতে হবে। একটি টবে ২টি কন্দও লাগানো যায়। রজনীগন্ধার জমির মাটিতে সবসময় রস থাকা উচিত। গ্রীষ্মকালে ৭ দিন পরপর এবং শীতকালে ১০ দিন পরপর সেচ দেওয়া উচিত। রজনীগন্ধার জমি সবসময় আগাছা মুক্ত রাখতে হবে। আগাছা দমনের সময় খেয়াল রাখতে হবে যেন কন্দের কোন ক্ষতি না হয়। আগাছা দমনে প্রয়োজনে অনুমোদিত আগাছানাশক ১.৮ কেজি একর প্রতি স্প্রে করতে হবে। রজনীগন্ধার জমিতে 'নিড়ানী' দিতে হবে। নিড়ানী দেওয়ার ফলে গাছ আলো, বাতাস এবং জল সহজেই পেতে পারে।  নিড়ানীর ফলে জমির আর্দ্রতার ধারন ক্ষমতা বাড়ে এবং আগাছামুক্ত রাখতে সাহায্য করে। রজনীগন্ধায় ধ্বসা রোগের ফলে গাছের শিঁকড়ে পচন ধরে। শেষে গাছের পাতা খসে যায় এবং ফুলের মঞ্জরীগুলো মাটিতে ঢলে পড়ে। আক্রান্ত গাছগুলো তুলে ধ্বংস করতে হবে। গাছের গোড়ার মাটি প্রতি লিটার জলে ৪ গ্রাম কুপ্রাভিট বা বেনডাজিম বা ব্যাভিস্টিন বা সেভিন মিশিয়ে সেই মিশ্রণ দিয়ে ভিজিয়ে দিতে হবে। রোগাক্রান্ত গাছে ১৫ দিন পরপর ২ থেকে ৩ বার প্রতি লিটার জলে ৪ গ্রাম হারে কুপ্রাভিট বা বেনডাজিম বা ব্যাভিস্টিন বা সেভিন মিশিয়ে প্রয়োগ করতে হবে। কৃমি গাছের শিকড়ে গুটি তৈরি করে। এই রোগে আক্রান্ত গাছের শিকড়ের মাঝে মাঝে ফুলের গিঁটের মত হয়ে যায়। ফলে গাছের মাটি থেকে খাদ্য ও জল নেওয়া ব্যাহত হয়। ফলে গাছ সহজে বাড়ে না এবং ফুলও আসেনা। দুর্বল হয়ে শেষে গাছ মরে যায়। দু’সারি রজনীগন্ধা গাছের মধ্যে এক সারি গাঁদা গাছ লাগিয়ে গাঁদা-রজনীগন্ধার মিশ্র চাষ করলে শিকড়ে গিঁট কৃমির উপদ্রব কম হয়। কন্দ রোপণের সময় সারির মাটিতে নিম খৈল ও নিউফরান ছিটিয়ে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে। তারপর সেখানে কন্দ রোপণ করলে এই রোগের আক্রমণ অনেক কম হয়। প্রাথমিকভাবে অল্প গাছ আক্রান্ত হলে সেসব গাছ তুলে জমি থেকে দূরে ফেলতে হবে বা পুড়িয়ে ফেলতে হবে। আক্রান্ত স্থানের মাটি কিছুটা গর্ত করে খড় জ্বালিয়ে মাটি পুড়াতে হবে। পাতার দাগ রোগের ফলে রজনীগন্ধার গাছের পাতার অগ্রভাগ থেকে প্রথমে দাগ পড়ে। পরে তা শুকিয়ে বাদামী হয়ে যায় এবং ধীরে ধীরে নীচের দিকে পাতার কিনারা বরাবর ঢেউ খেলানো দাগের মত নামতে থাকে। ফলে গাছ দুর্বল হয়ে শেষে মরে যায়। একই জমিতে পরপর এক নাগাড়ে রজনীগন্ধা চাষ না করাই ভাল। জমি তৈরির সময় একর প্রতি ৬ থেকে ৯ কেজি হারে রুটোন/এগ্রো-গ্রো (দানাদার) প্রয়োগ করলে শিকড়ের রোগ বালাই কম হয়। ফুল কাটা

কন্দ লাগানোর ৭০ থেকে ৯০ দিনের মধ্যে গাছে স্টিক আসতে শুরু করে।  স্টিক কাটার সময় ধারালো ছুরি ব্যবহার করতে হবে। রজনীগন্ধার স্টিকের প্রথম ফুল ফুটলেই ডাঁটিসহ ফুল কাটতে হবে। ভোরের ঠান্ডা আবহাওয়ায় অথবা পড়ন্ত বিকেলে ফুল কাটতে হবে। স্টিক কাটার সময় খেয়াল রাখতে হবে যেন এটি মাটি থেকে ১.৫ থেকে ২.৫ ইঞ্চি উপরে থাকে। কাটার সাথে সাথে স্টিক গুলির নীচের কাটা অংশ জলে চুবিয়ে ছায়ায় রাখতে হবে। যেন ফুল ও স্টিকের সতেজভাব বজায় থাকে। একর প্রতি রজনীগন্ধার স্টিক উৎপাদনের পরিমাণ প্রায় ১৫০০০০ থেকে ২০০০০০টি। রজনীগন্ধার কন্দ সহজেই উত্তোলন ও সংরক্ষণ করা যায়। ডিসেম্বর-জানুয়ারী মাসে গাছের বৃদ্ধি বন্ধ হয়ে গেলে কন্দ গুলি মাটি থেকে তুলে এনে পরিস্কার করে ছায়াযুক্ত শুকনো মেঝেতে ছড়িয়ে রাখতে হয়। পরিপক্ক কন্দগুলি পরবর্তীতে বীজ হিসাবে ব্যবহার করা হয়। এইভাবে চাষ করলে রজনীগন্ধার চাষে চাষিভাইদের লাভ অধিক হবে।