ঢাকায় মডেল পিয়াসা ও মৌ’র টার্গেট উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তান

author-image
New Update
ঢাকায় মডেল পিয়াসা ও মৌ’র টার্গেট উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তান

হাবিবুর রহমান, ঢাকা: বহুল আলোচিত মডেল ফারিয়া মাহবুব পিয়াসা ও মরিয়ম
আক্তার মৌকে ডিবি পুলিশ গ্রেফতার করেছে। তারা ছিলেন সংঘবদ্ধ ব্ল্যাকমেইল
চক্রের সক্রিয় সদস্য। মডেল পিয়াসা ও মৌ রাতের রানী বলেই সুপরিচিত। তারা
সারাদিন ঘুমিয়ে কাটাতেন। রাতে বিভিন্ন পার্টিতে গিয়ে উচ্চবিত্ত পরিবারের
সন্তানদের টার্গেট করে বাসায় ডেকে আনতেন। তারা উচ্চবিত্ত পরিবারের
সন্তানদের বাসায় মদ ও ইয়াবা খাইয়ে আপত্তিকর ছবি তুলে রাখতেন। সেই ছবি
বাবা-মা বা পরিবারের সদস্যদের দেখানোর ভয় দেখিয়ে ব্ল্যাকমেইল করতেন।
হাতিয়ে নিতেন মোটা অংকের অর্থ কিংবা আদায় করে নিতেন নামি-দামিসব পণ্য।
মডেল পিয়াসা ও মৌ গ্রেফতারের পর এমন ভয়ঙ্কর তথ্য বের হয়ে আসছে বলে দাবি
করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ ডিবি। গ্রেফতার হওয়া ফারিয়া মাহবুব
পিয়াসা ও মডেল মরিয়ম আক্তার মৌকে তিন দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন
আদালত।
সোমবার মরিয়ম আক্তার মৌকে ঢাকা মহানগর হাকিম আদালতে হাজির করে পুলিশ।
এরপর মোহাম্মদপুর থানায় মাদক আইনে করা মামলায় মৌকে ১০ দিনের রিমান্ডে
নিতে আবেদন করে পুলিশ। শুনানি শেষে ঢাকা মহানগর হাকিম মো. আশেক ইমাম
তিনদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
অপরদিকে, বিপুল পরিমাণ মাদকসহ রাজধানীর বারিধারা থেকে গ্রেফতার মডেল
ফারিয়া মাহবুব পিয়াসার তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। গতকাল
সোমবার ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট শহিদুল ইসলাম শুনানি শেষে
রিমান্ডের আদেশ দেন।
এর আগে, ঢাকা চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ফারিয়া মাহবুব
পিয়াসাকে হাজির করে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মো. আলমগীর সিদ্দিক ১০ দিনের
রিমান্ডের আবেদন করেন
জানা গেছে, বহুল আলোচিত মডেল ফারিয়া মাহাবুব পিয়াসা ও মরিয়ম আক্তার মৌকে
গ্রেফতার করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। তাদের বাসা থেকে
বিপুল পরিমাণ বিদেশি মদ, ইয়াবা ও সিসা উদ্ধার করা হয়েছে। গত রোববার রাত
১০টার দিকে প্রথমে রাজধানীর বারিধারায় মডেল পিয়াসার বাসায় অভিযান শুরু
করে ডিবি পুলিশ। পরে রাত পৌনে ১২টার দিকে তাকে গ্রেফতার করে
জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডিবি কার্যালয়ে নেওয়া হয়।
এদিকে পিয়াসার দেওয়া তথ্যেও ভিক্তিতে আরেক মডেল মরিয়ম আক্তার মৌ-এর
রাজধানীর মোহাম্মদপুরের বাবর রোডে অভিযান চালায় গোয়েন্দা পুলিশ। তার বাসা
থেকেও বিপুল পরিমাণ মদ উদ্ধার করা হয়। পরে রাত ১টার দিকে মৌকে গ্রেফতার
করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাকেও ডিবি কার্যালয়ে নেওয়া হয়েছে বলে জানায়
পুলিশ। মডেল পিয়াসা ও মৌ সংঘবদ্ধ একটি চক্র। তারা পার্টির নামে
উচ্চবিত্তদের বাসায় ডেকে মদ ও ইয়াবা খাইয়ে আপত্তিকর ছবি তুলে রাখতেন। পরে
সেই ছবি দেখিয়ে ব্ল্যাকমেইল করে মোটা অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নিতেন। আটকের পর
তাদের সম্পর্কে আরো চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে এসেছে। দুজন পরস্পসের সঙ্গে
যোগসাজশে নানা রকম অপরাধ করে আসছিলেন।
সরেজমিনে মৌয়ের বাসায় গিয়ে দেখা যায়, গনমাধ্যমকর্মীদের উপস্থিতিতে ওই
বাসায় অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছিল। মিরপুর রোড সংলগ্ন ২২/৯ বাবর রোডের ওই
বাসার নিচতলায় থাকতেন মৌ। বাসার ভেতরে ড্রয়িং রুমের পাশেই একটি মিনি বার
দেখা গেছে। বাসার ভেতরের বেডরুমের একটি ড্রয়ার থেকে পাঁচ প্যাকেট ইয়াবা
ট্যাবলেট উদ্ধার করেন গোয়েন্দা কর্মকর্তারা। এছাড়া ওই বেডরুমের ভেতরে
আরেকটি ড্রেসিং রুম থেকে অন্তত এক ডজন বিদেশি মদ উদ্ধার করা হয়।
তবে বাবর রোডের বাসা থেকে গ্রেফতারের পর মডেল মৌ সাংবাদিকদের কাছে অভিযোগ
করেন, ষড়যন্ত্র করে তাকে ফাঁসানো হচ্ছে। ভাসাবির জামানের বউ তাকে বাসায়
পুলিশ পাঠিয়ে শায়েস্তা করার হুমকি দিয়েছেন বলে দাবি করেন তিনি। মৌ
সাংবাদিকদের কাছে দাবি করেন, ভাসাবির জামানের বউ আমার পরিচিত। তাদের
বিভিন্ন প্রোগ্রামে গিয়ে পিয়াসার সঙ্গেও আমার পরিচয় হয়। ভাসাবির জামানের
বউ তানজি'র সঙ্গে ওদের কার যেন ঝামেলা হয়েছে, সেজন্য আমাকে ফাঁসানো
হচ্ছে। আমার বাসায় এসব মদ আর ইয়াবা আগে থেকে ছিল না।
সূত্র জানায়, গত দুই বছর আগে পিয়াসা নামটি বেশ আলোচনায় ছিল। দেশের প্রথম
সারির জুয়েলার্স প্রতিষ্ঠান আপন জুয়েলার্সের মালিক দিলদার আহমেদ সেলিম
তার সাবেক পুত্রবধূর বিরুদ্ধে মামলা করেছিলেন। তার সেই সাবেক পুত্রবধূর
নাম ফারিয়া মাহবুব পিয়াসা। চাঁদা দাবির অভিযোগে ২০১৯ সালের ৫ মার্চ সাবেক
পুত্রবধূর বিরুদ্ধে মামলা করেছিলেন দিলদার আহমেদ। মামলার পর ঢাকার মহানগর
হাকিম তোফাজ্জল হোসেনের আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিন চান পিয়াসা। মামলাটি
জামিনযোগ্য হওয়ায় তাকে জামিন দেন আদালত।
মামলায় দিলদার আহমেদ সেলিম অভিযোগ করেছেন, পিয়াসা দিলদারপুত্র সাফাতকে
ফাঁদে ফেলে ২০১৫ সালের ১ জানুয়ারি বিয়ে করেন। পরে তারা জানতে পারেন যে
পিয়াসা মাদকাসক্ত এবং উচ্ছৃঙ্খল জীবন-যাপনে অভ্যস্ত। তাই ২০১৭ সালের ৮
মার্চ পিয়াসাকে তালাক দেন সাফাত। এছাড়া ২০১৭ সালের মে মাসে রাজধানীর
বনানীর রেইনট্রি হোটেলে ধর্ষণের শিকার হন দুই বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রী। ওই
ঘটনায় করা মামলার এজাহারভুক্ত পিয়াসার স্বামী সাফাত। প্রথমে মামলা করতে
ভুক্তভোগীদের সহযোগিতা করেছিলেন আলোচিত এ মডেল । কিন্তু পরে পিয়াসার
বিরুদ্ধেই মামলা তুলে নেয়ার হুমকির অভিযোগে জিডি করেন ভুক্তভোগীদের একজন।
সেই ঘটনায় সারাদেশে তোলপাড় শুরু হয়।
এদিকে ২০১৯ সালের ১১ মার্চ দিলদারের বিরুদ্ধেও একটি মামলা করেন পিয়াসা।
মামলায় অভিযোগ আনা হয়, দিলদার আহমেদ পিয়াসাকে গর্ভপাতের চেষ্টা,
নির্যাতন, হত্যার হুমকি দিয়েছেন। তবে সে বছরের ১৭ জুলাই পুলিশ ব্যুরো অব
ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) পরিদর্শক মো. মজিবুর রহমান আদালতে দেয়া
প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন, পিয়াসার অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়নি।
এশিয়ান টেলিভিশনের সাবেক পরিচালক এবং প্রিভিউ কমিটির প্রধান ছিলেন ফারিয়া
পিয়াসা। দীর্ঘদিনের প্রেমিক ব্যবসায়ী শাফাত আহমেদকে বিয়ে করেন তিনি।
এনটিভির রিয়েলিটি শো ‘সুপার হিরো সুপার হিরোইন’র অন্যতম প্রতিযোগী ছিলেন
ফারিয়া পিয়াসা। সবশেষ গুলশানের অভিজাত ফ্ল্যাট থেকে মোসারাত জাহান মুনিয়া
নামে এক তরুণীর লাশ উদ্ধারের পর যে মামলা হয়েছিল সেখানেও পিয়াসার নাম
ছিল।
ডিএমপির সিরিয়াস ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন বিভাগের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার
(এডিসি) জোনায়েদ আলম সরকার জানান, রাজধানীর বারিধারা থেকে বিপুল মাদকসহ
গোয়েন্দা পুলিশের হাতে গ্রেফতার আলোচিত মডেল ফারিয়া মাহবুব পিয়াসা এবং
মোহাম্মদপুরের বাবর রোডের বাসা থেকে গ্রেফতার আরেক মডেল মরিয়ম আক্তার
মৌয়ের (মৌ আক্তার) বিরুদ্ধে মামলা করেছে পুলিশ। গতকাল সোমবার দুপুরে
গুলশান থানায় পিয়াসার বিরুদ্ধে এবং মোহাম্মদপুর থানায় মৌয়ের বিরুদ্ধে
পৃথক দুটি মামলা করেছে পুলিশ। মাদক আইনে করা দুই মামলায় দুজনকে ১০ দিন
করে রিমান্ড চেয়ে গতকাল বিকেলে আদালতে সোপর্দ করা হলে তাদেরকে ৩ দিন করে
রিমাণ্ড দেয় আদালত।
ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা (উত্তর) শাখার যুগ্ম-কমিশনার হারুন-অর-রশীদ
জানান, গ্রেফতারকৃত মৌ ও পিয়াসা তাদের বাসায় মদের আসর বসাতো মূলত
উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানদের ব্ল্যাকমেইল করার জন্য। এই বিষয়ে তদন্তে
সত্যতা পেলে ব্ল্যাকমেইলিংয়ের অভিযোগেও পৃথক মামলা করা হবে।
তারা দুজন একটি সংঘবদ্ধ চক্রের সদস্য। তাদের বিরুদ্ধে আমরা অনেক
ব্ল্যাকমেইলের অভিযোগ পেয়েছি। সেসব ঘটনা তদন্ত করতে গিয়ে রোববার তাদের
বাসায় অভিযান চালানো হয়। দুইজনের বাসায় বিদেশি মদ, ইয়াবা, সিসা পাওয়া
যায়। মৌয়ের বাড়িতে মদের বারও ছিল। আটক দুই মডেল হচ্ছেন রাতের রাণী। তারা
দিনের বেলায় ঘুমাতেন এবং রাতে এসব কর্মকাণ্ড করতেন। উচ্চবিত্ত পরিবারের
সন্তানদের পার্টির নামে বাসায় ডেকে আনতেন তারা। বাসায় আসলে তারা তাদের
সঙ্গে আপত্তিকর ছবি তুলতেন এবং ভিডিও করে রাখতেন। পরবর্তীতে সেসব ভিডিও
এবং ছবি ভিকটিমদের পরিবারকে পাঠানোর হুমকি দিয়ে ব্ল্যাকমেইল করতেন এবং
মোটা অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নিতেন।
আটকদের বিরুদ্ধে আইনি প্রক্রিয়ার বিষয়ে ডিবির যুগ্ম-কমিশনার
হারুন-অর-রশীদ বলেন, তাদের বাসায় মাদক পাওয়া গেছে। গতকাল সোমবার দুপুরে
গুলশান থানায় পিয়াসার বিরুদ্ধে ও মোহাম্মদপুর থানায় মৌয়ের বিরুদ্ধে পৃথক
দুটি মামলা করেছে পুলিশ। এছাড়া তাদের বিরুদ্ধে ব্ল্যাকমেইলিংয়ের অভিযোগ
থাকায় আলাদা মামলা হবে। এসব মামলায় তাদের রিমান্ডে নেওয়ার জন্য আদালতে
আবেদন করা হয়েছে।