সম্পর্কের নৈতিকতা

author-image
Harmeet
New Update
সম্পর্কের নৈতিকতা

​নন্দিনী ভট্টাচার্য: বহুদিন আগে আমার একজন মহিলার সাথে আলাপ হয়েছিল। উনি সেই সময়ে বিবাহিত ছিলেন না, কিন্তু উনি সেই সময়ে প্রেগন্যান্ট ছিলেন। এটা সমাজের চোখে ভীষণই লজ্জার ব্যাপার। যদিও উনি সেটা মনে করেন না। বরং সবার এত কৌতুহল দেখে উনি খুবই বিরক্ত। কারণ ওনার বন্ধু বান্ধবরা নাকি উত্যক্ত করছে কে ওই শিশুর বাবা এটা জানবার জন্য। উনি খুবই বিরক্ত হয়ে বলছিলেন, - " আমি বাচ্চার মা, এই পরিচয়টুকু কি যথেষ্ট নয়? আমার যার সাথে ইচ্ছে হবে সেই পুরুষকে তুড়ি দিয়ে ডেকে আনবো বাচ্চা জন্ম দেবার জন্য। কে ওর বাবা এটা কি খুব অর্থ রাখে?
আমি জানি, আপনারা কোনো মহিলার মুখ থেকে এই ধরণের কথা শুনতে অভ্যস্ত নন, তাই হয়তো আপনাদের চোখে ওই মহিলাকে খারাপ মনে হতে পারে, কিন্তু আমি মনে মনে মহিলাকে স্যালুট করেছিলাম, এমন ধরনের কথা বলার গাটস রাখেন বলে।
আসলে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় মহিলাদের ওপরে জোর করে এত কিছু নিয়ম চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে যার ফলে এখন অনেক মহিলার দমবন্ধ হয়ে আসছে। যোগ্যতা মেধার দিক থেকে এগিয়ে থেকেও প্রতিনিয়ত হেরে যাচ্ছে যোগ্যতার লড়াইতে। তাই অনেকে মহিলাই প্রতিবাদ করছেন এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজের চাপিয়ে দেওয়া নিয়মের বিরুদ্ধে। প্রতিবাদ মানে চিৎকার চেঁচামেচি নয়, অনেক ধরণের প্রশ্ন বা ভাবনা উঠে আসছে। নারীদের যেহেতু একটু নিচু চোখে দেখা হয়, তাই তাদের প্রতিবাদ করা নিয়ে কেউই খুব একটা আমল দেয় না। বরং নারীদের সমস্যা নিয়ে প্রশ্ন করলে এই সমাজের মাতব্বরেরা সেটা নিয়ে বিদ্রুপ করে। আর প্রতিবাদ করলে করলেই যে সমাজ রাতারাতি বদলে যাবে এমনটা নয়, তবু এই ধরণের প্রতিবাদী লেখা আমাদের নতুন করে ভাবতে শেখায়।
যেমন কিছুদিন আগে মন্দক্রান্তা সেনের একটা লেখা পড়ছিলাম, ওনার কথাগুলো ভাববার মত। উনি লেখাটা শুরু করেছিলেন ওনার অনেকদিন আগে লেখা দুটো কবিতা দিয়ে। একটি কবিতার নাম ছিলো ‘একটি অসম পরকীয়া’ আর অপর কবিতার নাম ছিলো ‘কাল থেকে আসব না’। প্রথম কবিতাটির মধ্যে ছিল এক ধরণের ঔদ্ধত্য, কবিতার লাইনগুলো ছিলো এই রকম, “শহিদ মিনারে উঠে গিয়ে/ বলে দেব আকাশ ফাটিয়ে/ইন্দ্রকাকু আমার প্রেমিক’। অর্থাৎ তথাকথিত সমাজের অনুশাসন তথা নৈতিকতার ধারণাকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেওয়ার প্রতিবাদ ছিলো এই কবিতায়। আর দ্বিতীয় কবিতার লাইনগুলো ছিলো এই রকম, “কাল থেকে আসব না, অনুরাধাদিরা বড় ভালো/যেতে পারব, হাত ছাড়ো, ঘরে গিয়ে মোমবাতি জ্বালো”। এখানে উনি একজন তরুণী গৃহশিক্ষিকার সঙ্গে তার চেয়ে দশ বছরের ছোট কিশোর ছাত্রের সম্পর্কের কথা লিখেছেন। দুটো কবিতার ক্ষেত্রেই সম্পর্কের তথাকথিত নৈতিকতাকে অস্বীকার করে লেখা হয়েছে। সমাজে নৈতিকতার নামে জোর করে চাপিয়ে দেওয়া নিয়মের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা হয়েছে এই কবিতার মাধ্যমে।
আগেকার দিনে মহিলাদের ওপরে চাপিয়ে দেওয়া নিয়ম নিয়ে কেউ কখনো প্রশ্ন তুলতো না, কারণ তখন মহিলারা এখনকার মত শিক্ষিত ছিলেন না ফলে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় তাদের ওপরে যেরকম নিয়ম চাপিয়ে দিয়েছিলো সেগুলোকেই তারা বেদবাক্য বলে মনে করতো। কিন্তু এখন মেয়েরা শিক্ষাদীক্ষায় অনেক এগিয়ে আছেন ফলে আগেকার দিনের মত সবকিছু নিয়ম চাপিয়ে দেওয়াটা আর সহজ হচ্ছে না, মুখ বুজে মেনে নিতে পারছেন না তারা, তাই তারা অনেক প্রশ্ন তুলছেন। তবে আজকে শুধু মন্দক্রান্তার লেখার বিষয় ধরেই কথা বলবো। সমাজে নারী পুরুষের সম্পর্ক নিয়ে দেখেছি প্রচুর লোকের মাথাব্যথা। পরিচিত বা অপরিচিত কাউকেই যদি সমাজের বানানো নিয়মের বাইরে বেরিয়ে সম্পর্ক গড়তে দেখা যায়, তাদের সমালোচনায় মুখর হয়ে ওঠে সবাই। কিন্তু এরকম সম্পর্ক নিয়ে গোটা সমাজের এত মাথাব্যথা কিসের জন্য, এই প্রশ্নও তুলেছেন মন্দক্রান্তা। উনি ওনার লেখাতে বলছেন, প্রেম মূলত একটি অনুভূতি, যে অনুভূতি নিতান্ত সেই ব্যক্তির। প্রেমে আবার নৈতিকতা কীসের? তাতে হস্তক্ষেপ করার অধিকার বাকিদের দিলো কে? আর কী করেই বা হস্তক্ষেপ করবে! এমনকি হয় নাকি যে, কাউকে সমাজ বলে দিলো, ছিইইই! তুমি বিবাহিত, তুমি স্বামী ছাড়া অন্য কারও প্রেমে পরবে কী করে! আর সেটাকেই বেদবাক্য বলে মেনে নিতে হবে? রামগরুড়ের ছানার মত বলতে হবে, "প্রেমের কথা শুনলে বলে প্রেমে পড়ব না না না না!" যদি কোনো মানুষের সঙ্গে কথা বলে তাকে ভালো লেগে থাকে, তবে কি এটা সেই ব্যক্তির দোষ, নাকি তার চাহনির দোষ! কাউকে খুব ভাল লাগলে কি ঘাবড়ে গিয়ে অন্যদিকে তাকাতে হবে? নৈতিকতা বিচার করে তাকে কি পালিয়ে থাকতে হবে নাকি!




সম্পর্কের সঙ্গে নৈতিকতার প্রসঙ্গ উঠলেই অবধারিতভাবে যৌনতার কথা উঠে আসে। কিন্তু নিছক যৌনতার জন্য কোনও দীর্ঘস্থায়ী সম্পর্ক গড়ে উঠতে পারে বলে মনে করি না। যারা এমন ভাবেন তারা আসলে সম্পর্ককে শ্রদ্ধার চোখে দেখেন না। অনেকে বলেন বিবাহের পরে নারী পুরুষের মধ্যে বন্ধুত্ব হওয়াটা তারা দোষের মনে করেন না, কিন্তু শরীরী সম্পর্ককে একেবারেই মেনে নেওয়া যায় না। কিন্তু বাস্তব অভিজ্ঞতা বলে, এটা শুধুই কথার কথা। বেশিরভাগ মানুষই ভালো চোখে দেখেন না নারী পুরুষের বন্ধুত্বকে। বহু ক্ষেত্রেই শুধুমাত্র বন্ধুত্বের সম্পর্ককেও সন্দেহের চোখে দেখে লোকেরা, তাদের সম্পর্ক নিয়ে আড়ালে রসালো কটু মন্তব্য করতে ছাড়ে না। কেউ কেউ যুক্তি দেন, কেন বাপু? বাড়িতে বউ থাকতে অন্য মহিলার সঙ্গে ভাব করার প্রয়োজন কি আছে? আমার তাদেরকে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করে কেন একজন পুরুষের একাধিক পুরুষ বন্ধুর প্রয়োজন হয়? তাহলে কি পুরুষের একজন মেয়ের সম্পর্ক গড়ে ওঠে শুধুই শারীরিক কারণে? এরকম ভাবনা ভাবেন মহিলারাও, তাদেরও একই বক্তব্য, ঘরে স্বামী থাকা স্বত্বেও কেন বাপু তোমার পুরুষ বন্ধুর প্রয়োজন হয়?
তবে মন্দক্রান্তা এই প্রশ্নও তুলেছেন, যদি একজন মহিলা অন্য কোনও পুরুষ বা নারীর সঙ্গে শুলে কি এমন মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে? শরীর আবার এমন কী বস্তু, যাকে নিয়ে এত ‘গেল গেল’ রব তুলতে হবে! প্রেমহীন যৌনতার কথা আমরা মহাভারতেও পাই, যাকে বলে নিয়োগপ্রথা। রানি সত্যবতী তাঁর পুত্র বিচিত্রবীর্যের মৃত্যুর পর বিধবা পুত্রবধূ অম্বা অম্বালিকাকে ব্যাসদেবের সঙ্গে সঙ্গমে বাধ্য করেছিলেন তাদের গর্ভে সন্তান উৎপাদেনের জন্য। এই যদি আমাদের ঐতিহ্য হয়, তবে এখন এত কথা কীসের, আমাদের সমাজের অভিভাবকদের?
শুধুমাত্র যৌনতা দিয়ে কোনো সম্পর্ক হয় করে না। যৌনতাসর্বস্ব সম্পর্ক একমাত্র যৌনপল্লীতেই হয়। কিন্তু যৌনপল্লীতেও সম্পর্ক গড়ে ওঠে কখনও কখনও, যখন শরীরের বিক্রেতা ও ক্রেতার মধ্যে অর্থের বদলে অন্য অর্থপূর্ণ একটা যোগাযোগ গড়ে ওঠে। এই যোগাযোগটা হৃদয়ের। পুরুষটি যদি বিবাহিত হয়, তবে সেটা অবৈধ সম্পর্কই বটে। কিন্তু পুরুষটির দাম্পত্য যদি প্রেমহীন হয়, তাহলে? শুধু নৈতিকতার নিরিখে প্রথমটাকে অপরাধ মনে করব?





একজন ভালোবাসার মানুষ অপর একজনকে ভালোবাসলে, সেটা তার পক্ষে খুবই যন্ত্রণার এটা সত্যি। তিনি যদি বিষাদগার করেন সেটার মানে তবু বোঝা যায়, কিন্তু বাকিদের কে অধিকার দিলো সেই ব্যাপারে কথা বলার? এখানে সমাজের ভূমিকা আসে কোথা থেকে? যখন কারো বিবাহ জীবন প্রেমহীন হয়ে যায়, যখন কোনো ব্যক্তির স্ত্রী বা স্বামী অবহেলা করে, সেখানে কি সমাজ কোনো দায় নেয়? এটা অনৈতিক বলে কি তারা প্রতিবাদ করে?
নৈতিকতার এই ধারণা আমাদের মধ্যে গড়ে ওঠে কী ভাবে? অন্যান্য প্রাণীদের মধ্যে তো তা নেই! ছোট গোষ্ঠীবদ্ধ প্রাচীন মানবসমাজেও তা ছিল না। সেখানে সহোদর ভ্রাতা-ভগ্নী, মাতা-পুত্র, পিতা-কন্যা সবার মধ্যেই যৌনতা ঘটত। তাকে অনৈতিক মনে করা হত না তো! এখনও ভারতবর্ষের কোনও কোনও অঞ্চলে মামা-ভাগ্নী কিংবা বিধবা বৌদি-দেওরদের বিয়ে হয়। আসলে দাম্পত্য মানে আবশ্যিক যৌনতা, প্রেম থাকুক আর নাই থাকুক। কিন্তু এসবকে কখনো অনৈতিক বলা যাবে না!

------আকাশ রায়

মতামত লেখকের ব্যক্তিগত