পরিবর্তনের যুগে আজও 'অপরিবর্তনশীল' মল্লিক বাড়ির দুর্গাপুজো

author-image
Harmeet
New Update
পরিবর্তনের যুগে আজও 'অপরিবর্তনশীল' মল্লিক বাড়ির দুর্গাপুজো

নিজস্ব সংবাদদাতা- কলকাতার বনেদি বাড়ির সাবেকি পুজো বলতেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে একচালা চালচিত্রের প্রতিমা।পুরোনো বাড়ির গন্ধ মাখা সেই আনন্দের সব উপাদান এখনও রয়েছে দক্ষিণ কলকাতার ভবানীপুরে মল্লিক বাড়ির দুর্গাদালানে। ৯৫ বছর ধরে দুর্গাপুজোর স্মৃতিবিজড়িত এই দালানটিতেই ১৯২৫ সালে উমার আরাধনা শুরু করেন রাধামাধব মল্লিকের পুত্রেরা। ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে জনপ্রিয়তা। এক পুজোকে কেন্দ্র করেই কলকাতার রূপে বদল এসেছে বহুবার। কিন্তু সেই পরিবর্তনের স্রোতে গা না ভাসিয়ে স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখেই এগিয়ে চলেছে মল্লিক বাড়ির দুর্গাপুজো। 





 জানা যায়, বর্ধমানের শ্রীখণ্ড এবং গুপ্তিপাড়া নিবাসী বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ রাধামাধব মল্লিকদের গুপ্তিপাড়ার বাড়িতে দুর্গাপুজোর চল ছিল বহু আগে থেকেই। তবে ভবানীপুরের বাড়ির অন্নপূর্ণা দালানে প্রথমে দুর্গা নয়, বরং তাঁরই অপর রূপ অন্নপূর্ণার আরাধনা শুরু হয়। পরবর্তীতে রাধামাধব মল্লিকের ছোট ছেলে সুরেন্দ্রমাধব মল্লিক এবং অন্যান্য ভাইদের উদ্যোগে শুরু হয় ‘আনন্দিতা শ্যামলী মাতৃকার চিন্ময়ীকে মৃন্ময়ীতে আবাহন’।







আজও কলকাতার পুজোর ইতিহাসকে সঙ্গে নিয়ে পথ চলছে মোহিনী মোহন রোডের এই বাড়ি। সেই ইতিহাসের প্রথম সাক্ষী দুর্গার কাঠামো। বৈষ্ণব সম্প্রদায়ভুক্ত মল্লিকবাড়িতে কাঠামোকেই ‘সকল দেবতার অধিষ্ঠান রূপে’ দেখা হয়। জন্মাষ্টমীর পরের দিন কাঠামো পুজো করে মৃন্ময়ীকে রূপদান পর্ব চলে বাড়ির ঠাকুরদালানেই। বাড়ির কুলদেবতা শ্রীধর নারায়ণের পুজোর সঙ্গেই সঙ্গেই মহালয়া পরবর্তী প্রতিপদ থেকে চণ্ডীঘরে শুরু হয় চণ্ডীপুজো। বোধন পূর্বে ডাকের সাজ, নাকের নথ, গলার হার, দশহাতে অস্ত্রশোভিতা দেবী তখন “সৌম্যহ সৌম্যতরাশেষ সৌম্যেভ্যস্তুতিসুন্দরী, পরা পরাণাং পরমা ত্বমেব পরমেশ্বরী।”





 বছরভর প্রতীক্ষার পর ষষ্ঠীতেই বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত পঞ্জিকামতে মল্লিকবাড়িতে শুরু হয় দেবী দুর্গার বোধন। বাড়ির আত্মীয়-পরিজনে ভরে ওঠে দুর্গাদালান। দুর্গতিহারিণীর প্রতি নিবেদিত ফুল-বেলপাতা-মন্ত্রে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে বাড়ি। এক একদিন একেক ফুলের মালা, এবং রুপোর ১০৮টি পদ্মমালায় দেবীকে সুসজ্জিতা করে তোলেন বাড়ির সদস্যরা। দেবীর পাশে রেখেই পুজো করা হয় শ্রীধর নারায়ণকে। গুপ্তিপাড়ার বৈষ্ণবমতেই পুজোর উপাচার চলে, তা সে সপ্তমীতে কলাবউ স্নান হোক, অষ্টমীতে কুমারী পুজো, অথবা নবমীতে হোম। 





চিরাচরিত নিয়মানুসারে অষ্টমীর ভোগে চাল বা তা থেকে উৎপন্ন সামগ্রী ব্রাত্যই রাখে মল্লিকবাড়ি। বদলে ভোগে নিবেদন করা হয় লুচি, আলু ফুলকপির তরকারি, বাঁধাকপির তরকারি, চাটনি, মিষ্টি এবং ফলফলাদি। পাশাপাশি সপ্তমী থেকেই চলে নৈবেদ্যর ডালি। একবছর পর পর আসা ‘মাহেশ্বরীস্বরূপেণ নারায়ণী’র সমাদরে আয়োজনের বিন্দুমাত্র খামতি রাখতে নারাজ মল্লিকরা। মল্লিক বাড়ির সদস্য স্বপ্না মল্লিকের কথায়, “পুজোর সবকটা দিন নৈবেদ্য দেওয়া হয়। তার আয়োজনও বিশাল। সপ্তমীতে ২৩, অষ্টমীতে ৩২, আবার নবমীতে ২৭, এরকম কমবেশি সংখ্যায় মাকে নৈবেদ্য অর্পণ করা হয়। সকাল থেকে ভোররাত অবধি চলে এই পর্ব।”





 অষ্টমীতে একসঙ্গে ‘নারায়ণী নমস্তুতে’ মন্ত্রে অঞ্জলি, পরবর্তীতে সন্ধিপুজো, ১০৮টি প্রদীপে সন্ধিক্ষণকে ধরে রাখার মতো উপাচারে যেন একচালাতেই মেলবন্ধনের গল্প বলে এ বাড়ির ঠাকুরদালান। ৯৭ বছরে পা দেওয়া ভবানীপুর মল্লিকবাড়িতে খানিক বিবর্তন এলেও পুজোর আনন্দ ম্লান হয়নি এতটুকুও। তবে বিসর্জনের বিদায়ের সুরকে সঙ্গে রেখেই একসময় এই বাড়ির সদস্যদের নাটক, গানে মাতোয়ারা হতো মল্লিক বাড়ির উঠোন। ‘লক্ষ্মণের শক্তিশেল’ থেকে ‘কর্ণাজুন’, ‘পান্ডব কৌরব’, ‘বিরিঞ্চিবাবা’, ‘ভাড়াটে চাই’-এর মতো নাটকে জমে উঠত বিজয়ার সভা। প্রসঙ্গত, বৈষ্ণব বাড়ি বলে পুজোর দিনগুলিতে নিরামিষ খাওয়াদাওয়ার আয়োজন হলেও বিসর্জনের পর খাওয়া হয় পাঁঠার মাংস এবং মল্লিক বাড়ির ‘সিগনেচার ডিশ’, মেটেচচ্চড়ি। পুজোর প্রথমদিন থেকেই এই রান্নাটি একইভাবে হয়ে আসছে মল্লিক বাড়ির হেঁশেলে।