ইউক্রেন যুদ্ধ থামাতে মার্কিন খসড়া নাকি রাশিয়ার ইচ্ছাপত্র? ট্রাম্প–প্ল্যান ঘিরে বিশ্বজোড়া চাঞ্চল্য

জেনেভায় মার্কিন-ইউক্রেন-ইউরোপ বৈঠকের মাঝেই ইউক্রেনের বিরুদ্ধে “শূন্য কৃতজ্ঞতা”র অভিযোগ তুললেন ট্রাম্প। ভূখণ্ড ছাড়ার দাবি, ন্যাটো ছাড়ার চাপ এবং রাশিয়া-ঘেঁষা শর্তে ক্ষুব্ধ কিয়েভ।

author-image
Tamalika Chakraborty
New Update
donald trump dance


নিজস্ব সংবাদদাতা: জেনেভায় রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ থামাতে নতুন মার্কিন পরিকল্পনা নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক বসতেই আচমকা বিস্ফোরক মন্তব্য করে রাজনৈতিক উত্তাপ বাড়িয়ে দিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ট্রাম্প রীতিমতো ক্ষোভে ফেটে পড়ে অভিযোগ করলেন—ইউক্রেনের নেতৃত্ব মার্কিন সহায়তার জন্য “একটুও কৃতজ্ঞতা দেখায়নি”, আর ইউরোপ এখনও রাশিয়ার তেল কিনে মস্কোকে শক্তি জোগাচ্ছে। তাঁর এই অভিযোগ প্রকাশ্যে আসতেই আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে নতুন উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছে।

ট্রাম্প তাঁর দীর্ঘ পোস্টে আবার দাবি করলেন, শক্তিশালী নেতৃত্ব থাকলে রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ কখনও শুরুই হতো না। তিনি বলেন, তিনি এমন এক যুদ্ধ উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছেন, যা আদৌ হওয়ার কথা ছিল না। তাঁর কথায়, ইউক্রেনের নেতৃত্বের ভঙ্গিতে তিনি গভীর বিরক্ত এবং এখন সময় এসেছে যুদ্ধ শেষ করার জন্য কঠিন সিদ্ধান্ত নেওয়ার।

এই মন্তব্য এমন সময় সামনে এল, যখন যুক্তরাষ্ট্র, ইউক্রেন এবং ইউরোপের প্রতিনিধিরা জেনেভায় বসে মার্কিন খসড়া শান্তি-পরিকল্পনা নিয়ে টানটান বৈঠক শুরু করেছেন। মার্কিন দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন সেক্রেটারি অফ স্টেট মার্কো রুবিও। বৈঠক যে একেবারেই হালকা পরিবেশে হয়নি, তা স্পষ্ট করেছে বহু বিদেশি রিপোর্ট।

মার্কিন পরিকল্পনার সবচেয়ে বিতর্কিত অংশ হলো দাবি—ইউক্রেনকে ডনবাস সহ পূর্বাঞ্চলের বড় অংশ রাশিয়ার হাতে ছাড়তে হবে, সেনাবাহিনীকে ব্যাপকভাবে ছোট করতে হবে এবং ন্যাটোতে যোগ দেওয়ার ইচ্ছে আনুষ্ঠানিকভাবে ত্যাগ করতে হবে। এই শর্তগুলো স্বাভাবিকভাবেই কিয়েভে ক্ষোভের ঝড় তুলেছে। ইউক্রেনের বহু সেনা এবং সাধারণ মানুষ মনে করছেন, এমন শর্ত মেনে নেওয়া মানে যুদ্ধবিহীন আত্মসমর্পণ।

ওদিকে ট্রাম্প আবারও মন্তব্য করেছেন, ইউক্রেনের হাতে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার মতো শক্তি নেই এবং খুব শিগগিরই তারা হারবে—এমনটাই তিনি দাবি করেছেন। তাঁর ভাষায়, “জেলেনস্কির হাতে কোনো কার্ড নেই।”

ukraine president and donald trump

এদিকে ইউরোপীয় মিত্রদের দাবি, এই খসড়া পরিকল্পনা তৈরির সময় তাদের মতামতই শোনা হয়নি। ইউরোপ এখন খসড়ায় পরিবর্তন এনে ভূখণ্ড ছাড়ার মতো শর্তগুলির বিরোধিতা করছে। ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ফন ডার লেয়েন সাফ জানিয়ে দিয়েছেন—বলপ্রয়োগে সীমান্ত বদলানো যাবে না এবং ইউক্রেনের সেনাবাহিনীকে দুর্বল করে দেওয়া চলবে না।

ইতিমধ্যে ইউক্রেন ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছে। ফ্রন্টলাইনে রাশিয়ার ধীর কিন্তু রক্তাক্ত অগ্রগতি, পোক্রোভস্কের দখল, সেনাসংখ্যার সংকট, ঘনঘন ব্ল্যাকআউট, বিদ্যুৎ পরিকাঠামোয় বোমাবর্ষণ—সব মিলিয়ে দেশের অভ্যন্তরীণ সংকট তীব্রতর। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ১০০ মিলিয়ন ডলারের দুর্নীতি–কেলেঙ্কারি, যা জেলেনস্কির সরকারের উপর চাপ আরও বাড়িয়েছে।

জেলেনস্কি নিজেই স্বীকার করেছেন, এটি দেশের ইতিহাসের “সবচেয়ে কঠিন সিদ্ধান্তের সময়।” তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন—এই মার্কিন পরিকল্পনা মেনে চললে ইউক্রেন মর্যাদা হারাতে পারে, আর অস্বীকার করলে হারাতে পারে সবচেয়ে বড় আন্তর্জাতিক মিত্র।

জেনেভার আলোচনায় ইউক্রেনের প্রতিনিধিদল নেতৃত্ব দিচ্ছেন আন্দ্রি ইয়ারমাক। মার্কিন দলের সঙ্গে তার দীর্ঘ বৈঠকের পরও সমাধানের আলো ফুটেনি। মার্কিন কর্মকর্তারা বলছেন, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এবং জেলেনস্কির মুখোমুখি আলোচনা না-হলে কোনও সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হবে না।

দ্বিপাক্ষিক চাপ-তাপক্রিয়ার মধ্যেই তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান জানিয়েছেন, তিনি পুতিনের সঙ্গে কথা বলবেন এবং জেনেভা আলোচনার ফল জানাবেন। রাশিয়া ইতিমধ্যে মার্কিন পরিকল্পনাকে ‘ভিত্তি’ হিসেবে গ্রহণযোগ্য বলেছে, যদিও তারা কিছু অংশে আপত্তি জানাতে পারে।

এই পরিকল্পনায় রয়েছে এমন কিছু ধারা, যা বিশ্লেষকদের মতে রাশিয়ার প্রচারের সঙ্গে মিলে যায়—যেমন ইউক্রেনে তথাকথিত ‘নাৎসি ভাবধারার’ বিলোপ। এই অংশটি এতটাই বিতর্কিত যে ইউক্রেনের জনমত এটি কখনই মেনে নেবে না।

ট্রাম্পকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, যদি জেলেনস্কি পরিকল্পনা মানতে রাজি না হন, তখন কী হবে? ট্রাম্পের জবাব স্পষ্ট ও কঠোর—“তা হলে সে তার মনভরে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে পারে।”

বিশ্বজোড়া উদ্বেগের মধ্যেই এখন সবার নজর জেনেভার আলোচনার ভবিষ্যৎ দিকে। এই পরিকল্পনা হবে কি যুদ্ধের পথ বন্ধ করার চাবিকাঠি? নাকি ইউক্রেনকে আরও গভীর সংকটে ঠেলে দেবে—এ প্রশ্নই এখন আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু।